ইন্তিফাদা বলতে বুঝায় জাগরণ, উত্থান বা প্রতিরোধ আন্দোলন। এই শব্দগুলোর মাঝে যে তীব্রতা ও বিপ্লবের আমেজ রয়েছে সেই বিপ্লবী কর্মসূচী কি এই “ইন্তিফাদা বাংলাদেশ” নামক সংগঠনে রয়েছে? ভিডিওতে আপনাদের কর্মসূচীর ঘোষণাগুলো শুনে আমার কাছে তেমনটা মনে হয়নি। ভিডিও থেকে মোটা দাগে কয়েকটি বিষয় বুঝতে পেরেছি। যেমন- মুসলিম জনগুষ্ঠির প্রতিনিধিত্ব করা, ইসলামের মূল্যবোধ রক্ষা করা, সরকারকে ইসলামের বিষয়ে নৈতিক পরামর্শ দেওয়া, গবেষণামূলক লেখনির মাধ্যমে গণতন্ত্রের অষাড়তা প্রমাণ এবং ইসলামী মূল্যবোধের বিকাশ করা ইত্যাদি। এই কার্যক্রমগুলোর মাধ্যমে ইন্তিফাদা শব্দের উপযুক্ত কর্মসূচী গৃহীত হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। তাই সাধারণ মুসলিম জনগুষ্ঠির পক্ষে আমি ইন্তিফাদা বাংলাদেশকে যেরূপ দেখতে চাই তার একটি রোডম্যাপ তুলে ধরা হলো-
গণতান্ত্রিক সিস্টেমকে পরামর্শ নয় হোক বিদ্রোহ: আপনারা জানেন যে, গণতন্ত্র নিজেই একটা জীবন ব্যবস্থা, যা ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে। তাই এই সিস্টেমকে পরমর্শ নয় বরং এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে মুসলিম জনসাধারণকে সচেতন করা। এই সিস্টেম কেন ইসলামের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং এর বিপরীতে ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যস্থার সৌন্দর্য তুলে ধরার মাধ্যমে মুসলিম জনসাধারণে মাঝে শরিয়াহ শাসনের তীব্র আকাংখা গণতন্ত্রের প্রতি তীব্র ঘৃণা তৈরি কর। যেন মুসলিম জনগোষ্ঠি এই গণতন্ত্রের উৎখাত করে ইসলামী শাসন কায়েমের স্বপ্ন দেখতে পারে।
বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং ঐক্যবদ্ধ জনশক্তি তৈরি করা: সদস্যদেরকে ইসলামের আলোকে নেতার আনুগত্যের গুরুত্ব তুলে ধরা এবং বিপদে-আপদে সদস্যদেরকে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ থাকারা নসিহত প্রদান করা।
সংগঠনকে ক্ষুদ্র শরিয়াহ হিসেবে পরিচালনা:
যেমন- ক) গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে সদস্যরা রাষ্ট্রিয় ও সামাজিক বিভিন্ন চাপের মুখে পতিত হবে এবং অনেকের জানমাল ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এসবের মোকাবেলায় সদস্যরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত সদস্য বা পরিবারকে অর্থ ও খাবার দিয়ে সহায়তা প্রদান করে এমন ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করতে হবে।
খ) সংগঠনের উদ্যোগে ফান্ড তৈরি করা হবে যেন, মজলুম সদস্যদেরকে সহায়তা প্রদান করা যায়। তাছাড়া প্রতিটি সাংগঠনিক প্রোগ্রামে যেন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সাধারণ সদস্যদের আর্থিক অবস্থার খোজ খবর নেয়। এতে করে কর্মীরা উজ্জীবিত হয়।
গ) বিত্তশালী সদস্যদের থেকে যাকাত আদায় করে অভাবী সদস্যদের পরিবারে বন্টন করা। এতেকরে সংগঠনের মজবুতি কায়েম হবে।
ঙ) সংগঠনের অধীনে আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার। যেন সংগঠনের কর্মীদেরকে আর্থিক আয়ের জন্য সুদ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকে পড়তে না হয়।
চ) বাস্তব জীবনে ন্যায় ও সততার পথে অবিচলতার পথে অটল থাকার পরামর্শ দেওয়া। বিশেষ করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা বাজায় রাখার ব্যপারে আপোষহীন নীতি অবলম্বন করা।
ছ) নিজেদের মধ্যে সংঘটিত ঝগড়া-বিবাদ সংগঠন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সালিশি বোর্ডের মাধ্যমে সমাধান করা।
কুরআনকে সংবিধান হিসেবে উপস্থাপন: বর্তমান মুসলিম সমাজ কুরআনকে কেবল নেকি অর্জনের মাধ্যম হিসেবে গণ্য করে। তাই কুরআনকে মানবতার মুক্তির সংবিধান হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে।
স্বতন্ত্র সভ্যতা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া: একটি আলাদা সংস্কৃতি ও সভ্যতা নির্মাণে নিজস্ব স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, গবেষণাগার, ব্যাংকিং সিস্টেম ডেভেলপ করতে হবে। যাকাত ব্যবস্থা চালু করতে হবে। কর্জে হাসানার ব্যবস্থা করা। । সর্বোপরি নিজস্ব কমিউনিটি ডেভেলপের কার্যক্রম হাতে নেওয়া।
সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ: বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে তরুণদেরকে সংগঠনে আকৃষ্ট করতে হবে। যেমন- রক্তদান কর্মসূচী, স্বেচ্ছায় রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, গরীবের ফসল ফলানো ও উত্তোলনে সহায়তা, অসহায়দের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। যেমন, ব্যাবসা গড়ে দেওয়া, গাড়ির ব্যবস্থা করে দেওয়া, কর্মে উৎসাহিত করা। ভিক্ষা ব্যবস্থাকে নিরুৎসাহিত করা।
গুণীজনকে আকৃষ্ট করা: দেশ ও সমাজের প্রভাবশালী, বিশেষজ্ঞ, শিল্পপতি, লেখক, সমাজ সেবক, আলেম, ইমাম ও এধরণের ব্যক্তিদেরকে দৃষ্টি আর্কষণ করা ও বিভিন্ন বৈঠকে অতিথি হিসেবে রাখার চেষ্টা করা। এতে কয়েক ধরণের লাভ হবে। যথা- হিংসা কমবে ও সংগঠনে আকর্ষিত হবে। আর্থিক ও জ্ঞানে সহায়তা পাওয়া যাবে। সমাজে সংগঠনের প্রভাব বিস্তার করা যাবে। সর্বশেষে তাদেরকে সংগঠনে যুক্ত করার পরিবেশ তৈরি হবে। তাছাড়া নতুন ইসলামী বক্তা, নতুন গবেষক, নতুন ইসলামী লেখকদের সাথে সবার আগে পরিচিত হওয়া, নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরা এবং দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করা।
প্রোগ্রামসমূহে ইহতেসাবের এজেন্ডা রাখা: নেতৃস্থানীয়দের ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ইহতেসাবমূলক প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মীদের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। সংগঠনের স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে দেওয়া নতুন পরামর্শ বিবেচনা ও গ্রহণ করতে হবে।
টেকসই সাংগঠনিক কাঠামোর বিন্যাস: সর্বোচ্চ নেতা একজন থাকবেন। তিনি সর্বোচ্চ মজলিশে শুরার সভাপতি এবং সর্বাধিনায়ক হবেন। তার টিমের আন্ডারে থাকবে বিভিন্ন বিভাগের কেন্দ্রিয় সভাপতিগণ, যাদেরকে এই টিম দিকনির্দেশনা দিবেন। আর এই কেন্দ্রিয়া সভাপতিগণ হবেন ১-৫ বছরের নির্দিষ্ট একটি মেয়াদ পর্যন্ত। মেয়াদ নির্দিষ্ট থাকলে প্রচেষ্টা বৃদ্ধি পায় এবং প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হয়, যা অনির্দিষ্ট কালের মেয়াদের ক্ষেত্রে তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। যেমন একজন ইবাদতকারী যদি জানতে পারে যে, সে আর এক মাস বেঁচে থাকবে, তাহলে ইবাদতে তার একনিষ্ঠতা ও ইবাদতের সময় বৃদ্ধি পাবে। যেমন- আলী বানাতের জীবনী।
তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠনকে বিস্তৃত করা: যোগ্য দায়িত্বশীল তৈরির উদ্দেশ্যে সংগঠনকে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত করা। যেমন- ছাত্র শাখা, যুব শাখা, শিশু-কিশোর শাখা ইত্যাদি। তারপর প্রতিটি শাখার জন্য- বিভাগীয় দায়িত্বশীল, জেলা, থানা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, গ্রাম/মহল্লা দায়িত্বশীল নিয়োগ দেওয়া।
সংগঠনে যুক্ত সদস্যরা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করা: যেমন- কারও কর্জে হাসানার দরকার হলে প্রদান করা, অভাবী থাকলে অভাব দূর করা, পরিবার ও সমাজ থেকে বঞ্চিত হলে আশ্রয় দেওয়া, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাকে যাকাত প্রদান করা, কর্মহীন হলে কর্মের ব্যবস্থা করে দেওয়া, বিয়েশাদীতে সাংগঠনিক অনুমতি ও সংগঠনের তত্ত্বাবধানে বিয়ের আয়োজন করা, সংগঠনের বাইরে বিবাহকে অনুৎসাহিত করা বা বন্ধ করা। কেননা এতেকরে পারিবারিক জীবনে মতানৈক্য সৃষ্টি হতে পারে এবং ব্যক্তি সংগঠন থেকে ছিটকে যেতে পারে।
নিজস্ব মিডিয়া তৈরি: বিরুধীদের অপপ্রচারের জবাব দিতে এবং নিজেদের আদর্শের প্রচারের জন্য মিডিয়া তৈরি, সাংবাদিক তৈরি, নিজস্ব সংবাদপত্র ও প্রকাশনী প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবী।
নিজস্ব স্কুল-কলেজ তৈরি: নিজস্ব স্কুল-কলেজ তৈরি করে দ্বীন ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বিত কারিকুলাম প্রণয়ন করে ছাত্রদেরকে দ্বীন ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার কর্মসূচী হাতে নেওয়া।
ভিন্ন ধারায় ইসলামের খেদমতকারীদের শুভাকাংখীর ভূমিকায় থাকা: ইসলামী ভাবধারার সকল ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, টিভি চ্যানেল, ফেসবুক গ্রুপ ইত্যাদির সমর্থন, সহমর্মিতা এবং কাছে আনতে হবে। এমনকি প্রতিটি চ্যানেলের সাবস্ক্রাইব ও মেম্বারদের সাথে অনলাইনে অফলাইনে যোগাযোগ ও পরিচিত হওয়া এবং তাদেরকে দলে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করা।
অনুশীলনযোগ্য ইসলামের নমুনা তৈরি:
বর্তমান আলেম সমাজ শুধুমাত্র মুখে ইসলামের গৌরবের কাহিনী বলে বেড়ায়। কিন্তু বাস্তবে অনুশীলন করা যায়, পর্যবেক্ষন করে দেখা যায় এবং সমষ্টিগতভাবে চর্চা করা যায় এমন একটি সমাজ সৃষ্টি করে দেখাতে পারেনি (যাদের মাঝে বসবাস করে বাস্তব ইসলামের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে)। তাই আপনারা এমন একটি সমাজ তৈরি করুন যেই সমাজে গিয়ে ইসলামের সৌন্দর্য্য কিছুটা হলেও পর্যবেক্ষন করে দেখা যাবে। যেমন-
ক) আপনাদের প্রতিষ্ঠিত স্কুলের দোকানে বিক্রেতা না থাকলেও ছাত্র-ছাত্রী বা বা শিক্ষক দোকানের জিনিস বিনামূল্যে বা কৌশলে কম মূল্যে নিবে না।
খ) বাগানের গাছগুলোতে ফল ঝুলে থাকলেও কোন সদস্য গাছ থেকে আম ছিড়ে খাবে না বা চুরি করে নিয়ে যাবে না।
গ) ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত পণ্যগুলোতে লাভের আশায় কেউ ভেজাল মিশ্রণ করবে না।
শেষকথা: সর্বশেষে বলতে চাই, প্রস্তাবিত এই নীতিগুলো পছন্দ হলে আরও বিস্তারিতভাবে লিখে দিতে প্রস্তুত আছি।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন