“তাড়াতাড়ি ভাত দাও তো! আজ মাঠে অনেক কাজ করতে হবে”- হাত-মুখ মুছতে মুছতে বলল বাদল।
“তুমি টেবিলে গিয়ে বস, আমি এখনই ভাত বেড়ে দিচ্ছি” বলল তার স্ত্রী নাজমা।
বাদল আর নাজমার সংসার প্রায় দুই বৎসর হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তাদের মুহব্বতে কোন ভাটা পড়েনি। আজকের যুগে স্বামী স্ত্রীর এমন বন্ধন প্রায় দেখাই যায় না। তাই তো তাদের দুজনের ভালোবাসা দেখে গ্রামের অনেকেই ঈর্ষা করে। কিন্তু কথায় আছে না- ‘এই দুনিয়ায় কেউ চিরসুখী হতে পারে না, কোন না কোন দিক দিয়ে অপূর্ণ থেকেই যায়’। তেমনি একটি দুঃখ তাদের রয়েই গেছে। এখনও তারা সন্তানের মুখ দেখতে পারেনি। চেষ্টাও কম করা হয়নি। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা না থাকলে চেষ্টায় কি আর সব হয়? তারপরও তারা বেশ সুখেই আছে।
বাদল লেখাপড়ায় মন বসাতে পারেনি। তাই সে ছোট থেকেই বাবার গৃহস্থের কাজ কর্ম দেখাশুনার দায়িত্ব নিয়েছে। পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া জমির পরিমাণও বেশ ভালই। তাই গৃহস্থ করেও বেশ সুখেই দিনগুলো পার হয়ে যাচ্ছে।
গত পাঁচ-সাতদিন যাবত বৃষ্টির দেখা নেই। তাই আজ সবগুলো ফসলের জমিতে পানি দিতে হবে। তাই সে আজ খুব সকাল সকাল খাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়ার জন্যই স্ত্রীকে তাড়া দিচ্ছে।
বাদল হাত-মুখ মুছে টেবিলে বসতেই তার স্ত্রী ভাত ও তরকারির ডিস নিয়ে, প্লেটে ভাত ও তরকারি উঠিয়ে দিচ্ছে। বাদল ভাত খাওয়া আরম্ভ করতেই দেখাগেলো রোদ কেমন ফিকে হয়ে আসছে। তারপর দেখতে দেখতে ঝকঝকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে ক্রমেই চারদিকে অন্ধকার নেমে এলো। বাদলের খাবার শেষ হতে না হতেই ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। এই দৃশ্য দেখে বাদল প্রশান্ত মনে বলে উঠলো- ভালোই হলো! অনেক খাটুনি থেকে রেহাই পেয়ে গেলাম। চেয়ারটা দরজার কাছে এনে সে বৃষ্টি উপভোগ করতে লাগলো। তার স্ত্রী হাত-মুখ ধুয়ে তার পাশে এসে বসল।
বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বাদল আনমনা হয়ে গেলো, যেন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। এই বৃষ্টি শুরু হলে মানুষের মনে কত ভাবনারই না উদয় হয়! সেও হারিয়ে গেলো ছোটবেলার হাজারও স্মৃতির পাতায়। হাঠাৎ কি এক কথা মনে করে মনের অজান্তেই হো হো করে হেসে উঠলো। নাজমা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। বাদলের হাসিতে তার তন্দ্রা ভেঙে গেলো।
: “এভাবে হেসে উঠলে কেন?”
: “ইয়ে মানে, এমনিতেই”- এই বলে বাদল কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে।
নাজমা আরও সন্দিহায় হয়ে উঠলো, সে ভাবলো হয়তো তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পাড়ায় তার চেহারা বিকৃত হয়ে পড়েছিল অথবা কাপড় চোপড় হয়তো অসাবধান হয়ে পড়েছিল, আর তা দেখেই বোধহয় বাদল হেসে উঠেছে। তাই নাজমা তাকে আরও ভালো করে জেরা শরু করলো।
“কি এমন হয়েছে যে, এত শব্দ করে হেসে উঠলে, এমনিতেই কি মানুষ হাসে? আমাকে বলো না প্লিজ…
কিন্তু বাদলের কোন উত্তর নেই।
“এই তুমি এখনো চুপ করে আছো কেন? হ্যা! কি হয়েছে..
বাদল আর চুপ থাকতে পারলো না। সে আর বলো না, এই বৃষ্টি দেখতে দেখতে অতীতের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো।
কি ঘটনা? বলো তো একটু শুনি: অনুনয় ঝড়ে পড়লো নাজমার গলায়।
বুঝতেই তো পারছো, ঘটনাটা বলতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু যেহেতু তুমি খুব করে বায়না করছো তাই বলছি। তবে সাবধান! এই কথা আর কারো সাথে শেয়ার করবে না, বলে দিলাম।
একথা শুনে নাজমার মনোযোগ কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। উদগ্রীব শুনতে লাগলো- কী সেই ঘটনা?
বাদল বলতে লাগলো- পাশের বাড়ির পলাশ আর আমার মাঝে ব্যাপক বন্ধুত্ব জমে উঠেছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন খেলতে গিয়ে তার ও আমার মাঝে ঝগড়া তৈরি হয়। একপর্যায়ে তাকে মারধর করতে থাকি। কিন্তু এই ঘটনা দূর থেকে তার বড়ভাই দেখে ফেলে। তাই সে দৌড়ে কাছে এসে আমাকে ধরে ফেলে এবং প্রচন্ডভাবে প্রহার করে। শুধু তাই নয়, সে আমার দুই হাত ধরে পলাশকে ইচ্ছামতো মারতে বলে। তখন পলাশ আমাকে অনেকক্ষণ কিল, ঘুষি আর লাথি মারতে থাকে। ইস! কি যে যন্ত্রণা! ভুলাই যায় না। এভাবে অনেকক্ষণ মারার পর পলাশের ভই আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলে, এই ঘটনা যদি তোর মা বাবাকে বলে দিস, তবে আরেকদিন দেখাবো মজা! এই হুমকী দেওয়ায় আমি এই ঘটনা মা বাবাকেও বলার সাহস পেলাম না। কিন্তু মনে মনে এই আঘাতের কঠিণ প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
দিন যায় দিন আসে, এক পর্যায়ে তার ও আমার মাঝে আবার বন্ধুত্ব তৈরি হয়। কিন্তু সেই ঘটনা পলাশ ভুলে গেলেও আমি কখনো ভুলতে পারি না। আমার অন্তরে প্রতিশোধের আগুন জ্বলতেই থাকে। কোনভাবেই সেদিনের অত্যাচার ও আঘাতের কথা ভুলতে পারি না। হঠাৎ একদিন আমার মাথায় শয়তান এসে ভর করলো। চিন্তা করলাম পলাশ আমাকে যে পরিমাণ আঘাত করেছে তার জন্য তাকে মরতে হবে, তাকে আমি শেষ করে দেবো। কিন্তু কিভাবে? যদি সবাই জেনে যায় তবে তো আমাকেও মরতে হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম তার ও আমার মাঝে যে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব বিদ্যমান আছে তা ধরে রাখতে হবে এবং আরো বাড়াতে হবে, যেন মানুষ আমাকে সন্দেহ করতে না পারে। তাই আমি তার সাথে আরো ঘনিষ্ঠ হতে থাকলাম।
একদিন তাকে বললাম চলো আমরা দুজনে আজ বিকালে চুপি চুপি পাশের জঙ্গলে খেলতে যাবো। তুমি একথা কাওকে বলবে না। সে আমাকে আশ্বস্ত করে বললো ঠিক আছে।
বাড়ি থেকে আমি কাওকে কিছু না জানিয়ে বিকেলে সেই জঙ্গলে এসে হাজির হলাম। কিছুক্ষণ পর সেও এসে উপস্থিত হলো। আশেপাশে কোন জনবসতি নেই। কোন মানুষের আনাগুনাও নেই। তখন শয়তান পুরোপুরি আমাকে আয়ত্বে নিয়ে ফেলেছে।হঠাৎ তার মুখে আমি প্রচন্ড বেগে এক ঘুসি বসিয়ে দিলাম। চিৎকার করে বলে উঠলাম, মনে আছে? সেদিন তোরা দুই ভাই মিলে আমাকে কত মার মেরেছিস? আজ তোকে আর জ্যান্ত ছাড়ছি না। ঘটনায় হতকিত হয়ে সে অনুনয় বিনয় হয়ে বলতে লাগলো? দুস্ত আমাকে মেরে ফেলিস না! তুই আমাকে যত পরস মার, আমি কাওকে কিছু বলবো না। কিন্তু অনুরোধ আমাকে একেবারে মেরে ফেলিস না! আমার জীবনটা ভিক্ষা দে! আমি বললাম, তোকে শায়েস্তা করার জন্য আমি কতদিন যাবত বন্ধুর অভিনয় করে আসছি জানস না। এই বলে তার গলায় ধরে পায়ে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে বুকের উপর চেপে বসলাম। সেই সময় শুরু হলো প্রচন্ড বৃষ্টি কিন্তু সেদিকে আমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। যখন সে দেখলো তার বাঁচার কোনই উপায় নেই তখন সে বলল, হে বৃষ্টির ফোঁটা! তুই ছাড়া আজ আমার কোন স্বাক্ষী নেই। তুই-ই আমার এই হত্যাকারির ব্যাপারে একমাত্র স্বাক্ষী।
তার করুণভরা সেই চাহনি আর কাকুতি মিনতি চোখে ভেসে উঠলে আজও আফসোস করি, কেন তাকে মেরে ফেললাম? যে আমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতো, জানের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো তাকে জীবনে তরে কেন মেরে ফেলাম? হায় আফসোস!
তার পিতামাতা এই ঘটনার তদন্তে কেস করেছিল। পুলিশ যখনই আমাকে জেরা করতে এসেছে তার পিতা-মাতাই বলেছে তাদের মধ্যে কোন ঝগড়া ছিল না। তারা এখনো একে অপরের প্রাণের বন্ধু। সে আমার ছেলের খুনি নয়। এই বলে তারাই আমাকে পুলিশের সন্দেহ থেকে দূরে রেখেছে।
প্রথম প্রথম বৃষ্টি হলেই মন আতকে উঠতো, না জানি এই বৃষ্টি তাদেরকে জানিয়ে দেয়! কিন্তু এখন তো এটা ভুলতেই বসেছি। আজ প্রায় দশ বারো বছর হয়ে গেলো, কত বৃষ্টি হলো- কই এই বৃষ্টি তো তাদেরকে কোন স্বাক্ষী দিল না! বৃষ্টি কি আর স্বাক্ষী দিতে পারে? কি বুকাই না ছিল পলাশ! এই বলে হাসতে থাকে বাদল।
ঘটনা শুনে নাজমার মন প্রকম্পিত হলো। যে মানুষটাকে সে এত সহজ সরল ভেবেছিল - সে ততটা সহজ সরল নয়। তাই সে মনে মনে খুব উদ্বীগ্ন হয়ে উঠলো। কিন্তু বাদলকে তা বুঝতে না দিয়ে উল্টো সে বলে উঠলো- সাবধান এই ঘটনা আর কাউকে বলো না। কেউ জানলে কিন্তু তোমার আর রক্ষা নেই।
দিন যায়, মাস যায়। একসময় বাদল ও তার স্ত্রীর বন্ধনের মাঝে ফাঁটল তৈরি হলো। কয়েকদিন পর দুইজনের মাঝে প্রচন্ড ঝগড়া বেঁধে গেলো। ঝগড়ার এক ফাকে বাদল হাতে লাঠি নিয়ে নাজমাকে মারতে যায়। তখন নাজমা দৌড়ে গিয়ে পলাশের মায়ের ঘরে আত্মগোপন করে। কিছুক্ষণ পর শুরু হলো বৃষ্টি।
নাজমা আনমনা হয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিযে আছে। আচমকা মনে পড়ে যায় পলাশের হত্যার কথা। মহিলা মানুষের দূরদৃষ্টি খুবই কম। কোন কথার কি পরিণতি হতে পারে তা অনেক সময় তারা অনুমান করতে পারে না। সে ভাবলো বাদলকে শায়েস্তা করার মুখ্যম একটা সুযোগ পেয়ে গেছি। কিন্তু সে কি জানে? এই ঘটনা প্রকাশ হয়ে গেলে বাদলের কি পরিণতি হবে? কিন্তু নাজমা এসব ভাবতে চায় না। ভাবখানা এমন যে, মুখ্যম সুযোগটি হাতছাড়া করার কোন মানে হয় না। তাই সে হাঁক ছাড়লো- চাচি! শুনেন একটা কথা কই..
ঘটনা শুনে বৃদ্ধ মহিলা চিৎকা করে কেঁদে উঠলো। সাথে সাথে লোকজন দৌড়ঝাপ করে জড়ো হলো। কি হলো মা? কাদেন কেন দাদি? কি হলো গো চাচি? সবাই এসে ঘটনা জানতে চাইলো। তখন পলাশের মা চিৎকার করে বলে উঠলো- এই বাদল আমার ছেলের খুনি! আমার বাবাকে সে কত কষ্ট দিয়েই না হত্যা করেছে! ওকে ধর, পুলিশে দে! হায় আল্লাহ! তাকে পুলিশের হাত থেকে বাচাঁনোর জন্য কত চেষ্টাই না করেছি! সাথে সাথেই ঘটনা চারদিকে ছাড়িয়ে পড়লো। পুরোনো কেস মামলা আবার সচল হয়ে উঠলো।
কি থেকে কি হলো নাজমা বিশ্বাসই করতে পারছে না। বেচারা বাদলের অপরাধ আদালতে প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তাকে ফাঁসির আদেশ দিল। এদিকে নাজমা কাঁদতে কাঁদতে বেহুশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। সবাই ধরাধরি করে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথায় পানি ঢালতে লাগলো। এরই মাঝে চারদিক অন্ধকার করে শুরু হলো বৃষ্টি। হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে গর্জে উঠলো আকাশ!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন