মসজিদে সালাত আদায় করতে গিয়ে সাধারণ মুসল্লিগণ কিছু ভুল সব সময়েই করে থাকেন। কিন্তু এগুলো নিয়ে ইমামগণ তেমন কোন কথা বলেন না। না বলার করণও অবশ্য আছে, কেননা তারা তো আর পিছনের সমস্যাগুলো দেখতে পান না। তাই যারা আমার মতো সাধারণ মুসল্লি আছেন তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই আজকের এই লেখা। পিছনে সালাত আদায় করতে গিয়ে আমার দেখা কিছু কমন ভুল নিয়ে এখানে আলোচনা করবো। সম্পূর্ণ লেখাটি পড়লে একজন সাধারণ মুসল্লি উপকৃত হবেন বলে আমার বিশ্বাস। চলুন দেখে নিই মসজিদে আমাদের কী কী ভুল হয়ে থাকে।
কাতারের সমস্যাগুলো:
ক) মাঝখানে না দাড়ানো: পিছনের একটি খালি কাতারে ঠিক কোথায় দাঁড়াতে হয় তা আমাদের অনেকের জানা নেই। তাই তো দেখা যায় কেউ কেউ খালি কাতারের এক কর্ণারে গিয়ে দাঁড়ান, আবার অনেকেই কাতার খালি পেলে ডানে বামে খালি রেখে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েন। এভাবে দাঁড়ানো উচিত নয়। পিছনের একটি কাতার খালি থাকলে আপনাকে ইমামের সোজা পিছনে দাঁড়াতে হবে। এভাবে মাঝখান থেকে দুই পাশে মুসল্লিরা ব্যালেন্স করে দাঁড়াবেন। যদি কেউ দেখেন ডান ও বামপাশে প্রায় সমান মুসল্লি আছে,তবে তার উচিত কাতারের ডানে দাঁড়ানো। কেননা, কাতারের নিয়ম হলো ডান পাশে কিছু মুসল্লি বেশি থাকা। তবে যদি দেখেন ডানে মুসল্লির সংখ্যা কয়েকজন বেশি রয়েছে তখন আপনার উচিত কাতারের বামে গিয়ে দাঁড়ানো।
খ) সামনের কাতার পূর্ণ না করে দাড়ানো: তেমনিভাবে মসজিদে অনেক সময় দেখয়া যায় সামনের কাতার পরিপূর্ণ হওয়ার পূর্বেই পেছনের নতুন আরেকটি কাতারে দাঁড়িয়ে পড়েন। এটাও সঠিক নয়। সামনের কাঁতার পূর্ণ হতে যদি একজনও বাকি থাকে তবে আপনাকে সামনের কাতারে গিয়েই দাঁড়ানো উচিত। সামনের কাতার ফাঁকা রেখে পিছনে আরেকটি নতুন কাতার করা উচিত নয়।
অন্যান্য সমস্যাঃ
গ) ফ্যান দখল যুদ্ধ: গরমকালে দেখা যায় মুসল্লিদের মাঝে ফ্যানের নিচে দাঁড়ানো নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। সামনের খালি থাকলো কি না বা ডানে কিংবা বামে মুসল্লি দাঁড়িয়েছে কি-না তার তোয়াক্কা না করে স্বার্থপরের মতো ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে পড়েন। সামনের কাতার পূর্ণ করেন না অথবা নিজ কাতারের ফাঁকা পূর্ণ করেন না। আবার দেখা যায় কোন মুসল্লি যদি খেয়ালবশত সামনের কাতারে চলে যান তখন পিছনের বয়োজ্যেষ্ঠ মুসল্লিকে সম্মান করার বাহানায় তাকে জোর করে ফ্যানশুন্য স্থানে ঠেলে দিয়ে উক্ত বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির ফ্যানের নিচের বাতাসময় জায়গা ছিনিয়ে নিতে চান। এগুলো খুবই দুঃখজনক আচরণ। একজন মুসলিমের উচিত অপর মুসলিমের প্রতি সদয় হওয়া, নিজের প্রয়োজনের চেয়ে অন্যের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দেওয়া। এটা চাই মসজিদে হোক বা দুনিয়ার যে কোন জায়গায়। অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার মনোভাব মুসলিমদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সুদৃঢ় করে। রাসূল (সাঃ) মুসলিম ভ্রাতৃত্ব অক্ষুন্ন রাখতে কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। হদিসে এসেছে, আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন,
لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ
“তোমরা ততক্ষণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ তোমার জন্য যা পছন্দ করো তোমার ভাইয়ের জন্যও তা পছন্দ না করবে।” (বুখারী, ইঃ ফাঃ হদিস নং ১২, ইন্টাঃ নং ১৩)
গ) ফোন বেজে উঠা ও এর প্রতিক্রিয়া: বর্তমানে প্রায় প্রত্যেক জামাত শুরু করার পূর্বে মুসল্লিগণকে মোবাইল ফোন বন্ধ করতে বলা হলেও অনেকে খেয়াল করে বন্ধ করেন না। এতেকরে মোবাইল ফোন বেজে উঠলে নিজে যেমন বিব্রতকর অবস্থায় পতিত হন, সালাতে মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটে তেমনি অন্যের সালাতেও ব্যাঘাত ঘটে। তাই প্রত্যেক সালাত আদায়ের পূর্বে খেয়াল করে মোবাইল ফোন নিজ দায়িত্বে বন্ধ করে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। পক্ষান্তরে অন্যের ফোন বেজে উঠলেও চেচিয়ে ওঠার দরকার নেই। কারণ আপানি যেমন মাঝে মাঝে ফোন সাইলেন্ট করতে ভুলে যান তেমনি অন্যরাও ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। আসলে অন্যের ভুৃলগুলো বড় করে দেখা আমাদের জন্য কল্যাণকর নয়।
ঘ) চেয়ারে সালাত আদায়ে যে সমস্যা হয়/চেয়ারে কি সালাত আদায় হবে? : অনেকেই সামান্য কারনে চেয়ারে বসে সালাত আদায় করেন। দেখা যায় সালাতের বাহিরে মিলাদ-মাহফিলে গিয়ে বসে থাকতে পারেন, বাড়ির মেঝেতে বসে খাওয়া-দাওয়ার কাজ সারতে পারেন, কিছু পড়ে গেলে নিচ থেকে উঠাতে পারেন এসব সত্যেও মসজিদে আসলে সালাত আদায়ের জন্য চেয়ার তালাশ করেন। সামান্য কারণে চেয়ারে সালাত আদায় করা উচিত নয়। এরূপ সালাত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমি মনে করি না। তবে প্রকৃত অর্থেই যারা মাজুর তাদের উচিত চেয়ারের সামনে ছোট টেবিল বা টুল রাখা এবং সিজদার সময় নাক এবং কপাল ঠেকানো। শুন্যের উপর সিজদা করা এবং হাত সমেত শুন্যে ভাসিয়ে রাখা এক সাথে সালাতের অনেকগুলো বিষয়ের খেলাফ হয়। সালাতে আল্লাহর কাছে মাথা ও কপাল দিয়ে আনুগত্য না করা হলে প্রকৃতপক্ষে আনুগত্যের চরম পরাকাষ্ঠা ফুটে উঠে না।
ঙ) যে বুদ্ধির অভাবে মসজিদ হতে বের হতে গিয়ে মাঝপথে আটাক পড়তে হয় : ফরজ সালাত শেষ হলে অনেকে জরুরী প্রয়োজনে বাইরে বের হতে চান। কিন্তু অনেকেই জানেনা কখন নিরাপদে বের হওয়া যায়। বিশেষত যে ফরজ সালাতের পর সুন্নত পড়া হয়। তখন তারা বের হতে গিয়ে মাঝপথে আটকা পড়েন। কেননা মাঝপথে পৌঁছার পর দেখা যায় অনেকেই সুন্নত পড়ার জন্য নিয়ত বেধে ফেলে। তো আপনি যদি নিরাপদে বের হতে চান তবে ফরজ সালাত শেষ হওয়ার পর মোনাজাতের পূর্বেই বের হওয়ার জন্য উঠে পড়ুন। এতে বের হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পাবেন এবং মাঝপথে আটকে থাকা লাগবে না।
চ) দামী জুতা চুরি যাওয়া যেভাবে ঠেকাবেন: আমাদের দেশে মসজিদে মুসল্লিবেশে অনেক সময় জুতা চুর তার চুরিকার্যের উদ্দেশ্যে মসজিদে আসে। তাদের টার্গেট থাকে দামী জুতার দিকে। তাই আপনি যদি দামী জুতা পড়ে মসজিদে আসেন তবে সম্ভব হলে আপনার সামনের কাতারের র্যাকে জুতা রাখুন অথবা দু পায়ের দুইটি জুতা ভিন্ন দুইটি র্যাকে রাখার চেষ্টা করুন এতেকরে জুতা চুরির সম্ভাবনা কমে যাবে।
ছ) সালাত আদায়কারীর সামনে দিয়ে চলা: সালাত আদায়কারীর সামনে দিয়ে চলা হাদিসে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু অনেকেই তা জানেন না। আবার যদি আপনার সালাত আদায়রত অবস্থায় কেউ আপনার সামনে দিয়ে যেতে চায় তবে সালাতরত অবস্থায়ই আপনাকেও বাধা দেয়ার চেষ্টা করতে হবে এটা অধিকাংশ মুসল্লিই অবগত নন। নিয়ম হলো কোন ব্যক্তি যদি সালাত আদায়কারীর ডান পাশ দিয়ে বামে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন তবে সালাত আদায়কারী কথা না বলে তার ডান হাত সামনে প্রসারিত করে আগন্তুককে বাধা প্রদান করবেন বা ইশারা করে বারণ করবেন। অনুরূপ বাম দিক দিয়ে ঢুকতে চাইলেও বাধা প্রদান করবেন।
যখন সালাত আদায়কারীর সামনে দিয়ে চলা যায়: ফরজ সালাত শুরু হয়ে গেছে এমতাবস্থায় যদি কেউ সুন্নত আদায় চলমান রাখে এবং তার সামনের কাতার ফাঁকা থাকে তখন অপর মুসলিমের উচিত তার সামনে দিয়ে হলেও কাতার পূর্ণ করা এবং তখন সুন্নত আদায়কারী অন্যদেরকে সামনে দিয়ে যেতে বাঁধা প্রদান করবেন না। পক্ষান্তরে যদি সুন্নত আদায়কারী দেখেন যে, তার সুন্নাত শেষ করতে করতে ফরজের এক রাকাত ছুটে যাবার সম্ভাবনা আছে তবে তিনি সুন্নাত ছেড়ে দিয়ে ফরজ সালাতে অংশগ্রহণ করবেন এবং পরবর্তীতে উক্ত সুন্নাত আদায় করে নিবেন। কারণ ফরজের গুরুত্ব অধিক। ফরজ সালাতের কয়েক মুহূর্ত সুন্নাতের ধারাবাহিক কয়েক বছর আমলের চাইতেও বেশি।
জামাত শেষে জরুরী আমল: মোনাজাত নাকি দোয়ায়ে মাসনূন: ধরুন আপনার একটি মোবাইল ফোন কেনা প্রয়োজন। দোকানে গিয়ে দেখলেন সমান দামের দুটি মোবাইলের মধ্যে একটিতে কোম্পানী গ্যারন্টি দিয়েছে। অন্য কোম্পানীর একই মূ্ল্যের মোবাইলে কোন গ্যারান্টি বা ওয়ারেন্টি দেয়নি। এমতাবস্থায় আপনি বুদ্ধিমানের অধিকারী হলে গ্যারান্টিযুক্ত ফোনটিই কিনবেন।
রাসূল (সাঃ) কিংবা তার সাহাবীদের কেউ ফরজ সালাত শেষে সম্মিলিত মোনাজাত করেছেন মর্মে কোন সহীহ হাদিস পাওয়া যায় না। তবে ফরজ সালাত শেষে বিভিন্ন মাসনূন দোয়ার ফজিলতের কথা বহু হাদিসে উল্লেখ আছে। এ ব্যাপারে আপনি নিজেও একটু ঘাটাঘাটি করে দেখতে পারেন। অতএব আপনি যদি বুদ্ধিমান সালাত আদায়কারী হোন তবে তাড়াহুড়ো করে মোনাজাত না করে গুরুত্বপূর্ণ মাসনূন দোয়াগুলো পড়তে থাকুন যতক্ষণ অন্যদের মোনাজাত চলতে থাকে। বিশেষ করে আয়াতুল করসী এবং ৩৩ বার করে সুবহানাল্লা ও আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার। অবশ্য ধারাবাহিক আরও বেশকিছু মাসনূন দোয়া আছে, যা উল্লেখ করা এখানে সম্ভব হচ্ছে না।
সমাপ্ত
২) ছোটদেরকে মসজিদে আনা কি উচিত?: আমরা অনেকেই মনেকরি ছোটরা মসজিদে আসলে চিৎকার চেচামেচি করে, দৌড়াদৌড়ি করে, হাসাহাসি করে ইত্যাদি। তাই তাদেরকে মসজিদে আনা উচিত নয়।
** ছোটদের ভুল ও বড়দের ভুল: ২) ছোটরা কি মসজিদে আসবে না? ৩) ছোটরা চিৎকার করলে কি সালাত ভঙ্গ হবে? ছোটরা মসজিদে হাসলে বড়রা কি তাড়িয়ে দেবে? রাগারাগি করবে? ছোটদের আগ্রহী করতে ব্যতিক্রমী কিছু উদ্যোগের ঘটনা, তুরষ্কের ইমামের আক্ষেপ। রাসূল (সা:) এর সালাত ও ইমাম হাসান-হোসাইনের শিশু সুলভ আচরণ এবং আমাদের শিক্ষা।
মহিলারা মসজিদে আসলে যে বিপ্লব সম্ভব: ক) মহিলারা আলোচনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে খ) বেপর্দা করে স্কুলে পাঠালে অভিভাবক ভয় পায় না তবে মসজিদে পাঠানোতে ভয় কি নেক সুরতে শয়তানের ধোকা?
রাসূল (সা:) এর থেকে কি আমাদের বেশি বুঝা উচিত হবে? তিনি কোন সালাত কি মহিলা মুসল্লি ছাড়া আদায় করেছেন?
যারা মহিলাদের মসজিদে আসায় বাধা দেয় তাদেরকে প্রথমেই প্রশ্ন করা যে, দ্বীনের ব্যপারে আমাদের কারও বুঝ কি রাসূল (সাঃ) এর চেয়ে বেশি হওয়া উচিত? বলবে: না। তবে, রাসূল (সাঃ) এর কোন ফরজ সালাত কি সম্পন্ন হয়েছে যেখানে মহিলা সাহাবীরা মুসল্লি ছিলেন না?
তারা বলবে তিনি মহিলাদেরকে নিরুৎসাহিত করেছেন, তখন আপনি বলবেন, তিনি মহিলাদের জামাতে শামিল হওয়ার বিষয়ে পুরুষদেরকে কী নসিহত করেছেন? উল্লেখ্য পুরুষদেরকে বলেছেন, যদি মহিলারা জামাতে শামিল হতে চায় তবে পুরুষরা যেন বাধা প্রদান না করেন। তারপুর বলুন: আমাদের দেশে বা সমাজের মসজিদগুলোতে যে, মহিলাদের সালাতের ব্যবস্থাই রাখা হয় না এর চেয়ে বড় বাধা দান কি হতে পারে?
🕮আরও পড়ুন...
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ কি গ্রহণযোগ্য?
ইসলাম কি প্রতারকদের আশ্রয় দিতে বলে?
মাদরাসার ছাত্ররা যেকারণে বেশি খারাপ হয়
মসজিদগুলোর উন্নতি যখন মানবিক অবনতির কারণ
এদেশের প্রচলিত সালাম কি সঠিক? জেনে রাখা জরুরী
যে প্রশ্নের উত্তর নেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কাছে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন