সোমবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৫

“ইসলামী সমাজ” সংগঠনের ভুলগুলো


আমি এক সময় জামায়াতে ইসলামীতে যুক্ত ছিলাম। এক সময় খেয়াল করলাম যে এই সংগঠনটি  ইসলামের নামে দিয়ে মূলত গণতন্ত্রকেই প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যা কখনোই ইসলামের সাথে সামঞ্জস্য নয়। বরং এটা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক এবং ইসলামকে গণতন্ত্রের সাথে মিশ্রিত করার মত অপরাধ। তাই একটি সঠিক ইসলামী দল তালাশ করতে থাকলাম। অনলাইনে বহু খোজাখোজির পর ইসলামী সমাজ নামক সংগঠনের দেখা পাই। তাদের যে মূলনীতিটি আমাকে আকৃষ্ট করে তা হলো তারা গণতন্ত্রের ঘোর বিরুধী। তাই আমি নিজ উদ্যোগে তাদের ফোন নাম্বার সংগ্রহ করি এবং সংগঠনে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করি। তবে প্রাথমিক যোগদানের পর তাদের কিছু মারত্মক ভুল নীতি আমার দৃষ্টিগোচার হয়, ফলে আবার আমি হতাশ হয়ে পড়ি। যে ভুল নীতিগুলো দেখে এই সংগঠন থেকে দূরে সরে আসা সেই নীতিগুলোরই ধারাবাহিক বর্ণনা করবো এই আলোচনায়। যেন তারা সংশোধিত হতে পারে অথবা আমার ভুল ধরিয়ে দিতে পারে। তাহলে চলুন তাদের ভুল নীতিগুলো নিয়ে আলোচনা শুরুকরি-

হিকমার বড় অভাবঃ একজন দায়ীকে হিকমার অধিকারী হতে হয়। একজন হিকমাহ ওয়ালা দায়ী কখনো একজন অমুসলিমকে এভাবে দাওয়াত দেবে না যে, “এই ব্যাটা তুই তো কাফের! ইসলাম গ্রহণ না করলে তুই জাহান্নামে যাবি। তাই বাঁচতে হলে তোকে ইসলাম গ্রহণ করতেই হবে। তাই যদি বাঁচতে চাস তো ইসলাম কবুল করে নে!” যদিও তার কথাগুলো সঠিক তবে এটা হিকমাহ’র খেলাফ। আপনাদের বেলায়ও অনুরূপ হিকমাহের খেলাফ কিছু কথা হলো ক) মক্কা-মদিনাসহ পৃথিবীর কোন দেশই ইসলামের উপর নেই, একমাত্র আমরাই ইসলামের উপর কায়েম আছি। খ) সারা বিশ্বের মধ্যে একমাত্র আমরাই হকপন্থী দল। গ) আমাদের আমীর আল্লাহর মনোনীত অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা তাদের আমীরকে মনোনয়ন দিয়েছেন। ঘ) অমুক দাল বাতিল এটা ১০০% গ্যারান্টি, ১০০% গ্যারান্টি যে,  আমরাই হকের দল। ঙ) আমাদের আমীর সারা বিশ্বের একমাত্র বৈধ নেতা ইত্যাদি। একজন সামান্য হিকমাহওয়ালা ব্যক্তিও এমন কথা বলতে পারেন না। কারন সত্য হলেও এভাবে বলা হিকমার খেলাফ এবং ঔদ্ধত্বপূর্ণ অহংকারী আচরণ। এভাবে কথা বললে মানুষ বিরক্ত হয়। ফলে দাওয়াতের প্রভাব সাড়া ফেলতে পারে না। দাওয়াত তো সেটাই যার দ্বারা নিজেদের উদ্দেশ্য সাধিত হয় এবং কেউ বাঁকা দৃষ্টিতে নেওয়ার সুযোগ না পায়।

নড়বড়ে সাংগঠনিক কাঠামোঃ একটি সংগঠনকে শক্তিশালী করতে এর সাংগঠনিক ভীত খুব শক্তভাবে নির্মাণ করা দরকার। আর এজন্য প্রয়োজন প্রতিটি পাড়ায়-মহল্লায় দায়িত্বশীল নিয়োগ করা। যোগ্য লোকের অভাব হলে প্রয়োজনে সমর্থকদের মাঝে দায়িত্ব বন্টন করে দিয়ে তাদেরকে মনিটরিং এর ব্যবস্থা করা। যাতে স্থানীয় সংগঠন শক্তিশালী হয়। কিন্তু আপনারা তা না করে ভ্রাম্যমান এবং ভাসমান দাওয়াতের নীতি গ্রহণ করেছেন (যোটকে বলা যায় পিকনিক মার্কা দাওয়াত) । আজ ঢাকা তো কাল বরিশাল, কাল বরিশাল তো পরশু সিলেট। এভাবে প্রতিদিন দৌড়-ঝাপ করলে কি আদৌ একটি সংগঠনকে মজবুত করা যাবে? প্রয়োজনে তো এই উদ্যোগ নিতে পারেন যে- যেই এলাকায় দাওয়াতের উদ্দেশ্যে বের হবেন সেখানে অন্তত তিন-চার দিন বা এক সপ্তাহ সময় দিবেন এবং স্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্য থেকে আপনাদের কিছুসংখ্যক সমর্থক তৈরি করে নিবেন। তারপর তাদেরকে ছোট ছোট দায়িত্ব দিয়ে একজন দায়িত্বশীলের সাথে তাদেরকে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিবেন, যাতে ঐ দায়িত্বশীল তাদেরকে কাজে লাগিয়ে ঐ এলাকায় সংগঠনের বিস্তার করতে সক্ষম হয়। 

মিডিয়া ও প্রকাশনীবিহীন সংগঠনঃ বর্তমান যুগ হলো মিডিয়ার যুগ। একটি শক্তিশালী মিডিয়া একশত দায়ীর ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ মিডিয়ার মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থান ও সময়ের একটি বক্তব্যকে পৃথিবীর সকল স্থানে এবং দীর্ঘ সময় ধরে প্রচার করা যায়। কিন্তু এই মিডিয়াকে শক্তিশালী করার কোন উদ্যোগ ও চিন্তা তাদের আছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া সমাজের চিন্তাশীল মানুষেরা ইসলাম নিয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনা লেখালেখির মাধ্যমে প্রকাশ করতে চায়। তাদেরকে সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করতে সংগঠনের প্রকাশনীতে তাদের লেখা আহ্বান করা প্রয়োজন। এতে শিক্ষিত ও চিন্তাশীল মানুষেরা সহজেই সংগঠনে আকৃষ্ট হতে পারে। তাছাড়া সংগঠনের আভ্যন্তরীণ দায়ীত্বশীলগণও একটি প্রকাশনীর মাধ্যমে বাস্তবতার আলোকে করণীয়গুলো সবার মাঝে শেয়ার করতে পারে। কিন্তু ইসলামী সমাজের দায়িত্বশীলরা এটা বুঝে উঠতে পারছেন না। ফলে কেন্দ্রের উদ্যোগে কোন মিডিয়া পরিচালিত হয় না এবং কোন প্রকাশনীও বের হয় না।

যোগ্যতার প্রতি নেই কোন ভ্রুক্ষেপঃ দুনিয়াবী কোন কোন দিকগুলোতে গুরুত্ব দেওয়ার কারণে অন্যান্য দলগুলো এগিয়ে যাচ্ছে সেই দিকগুলো গ্রহণ এবং নিজেদের কোন কোন দিকগুলো সংশোধনের প্রয়োজন সেদিকে খেয়াল নেই, এ বিষয়ে কোন গবেষণার প্রয়োজন মনে করেছে না। তাদের কাল্পনিক ধারণা- একদিন  চূড়ান্ত পরীক্ষার সম্মুখিন হবো এবং চূড়ান্ত পরীক্ষার পর বিজয়ী হয়ে যাবো! কি কল্পনা বিলাস!

চেতনা বিমুখ সমর্থক ও সহযোগী তৈরিঃ এই সংগঠন থেকে বলা হয় যে, এই সংগঠনের কর্মীদের ভূমিকা দুই ধরনের- ক) আনসার খ) মুহাজির। তাই যারা টাকা দিয়ে শামিল হবে তারাও দাওয়াতের কাজে সমান সওয়াব পাবে। ফলে যারা টাকা দিচ্ছে তারা দায়-দায়িত্ব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে টাকা দিয়ে দায়ী ও কর্মীদের পেলে-পুষে ইসলাম কায়েম করতে চায়। নিজেদেরকে সংঘাত থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে চায়। এরকম শুভাকাঙ্খি আর কর্মী বাহিনী দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা কি অলীক কল্পনা নয়? ইতিহাস স্বাক্ষী যে, মুহাজীর সাহাবাগণও (রাঃ) অন্যের সংসারের বোঝা না হয়ে ব্যবসা করে নিজ উপার্জনে চলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। 

প্রোগ্রামে আত্মসমালোচনার উন্মুক্ত ব্যবস্থার অভাবঃ মানুষ মাত্রই ভুল করে। দায়ীত্বশীলগণও ভুল করে থাকে। তবে তাদের এই ভুলগুলোর কারণে কর্মীরা মনে মনে বিরক্ত হলেও ভুলগুলো  ধরিয়ে দিতে সাহস পায় না। তাই মাঝে মাঝে বৈঠকের শেষে নিজেদের ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে কর্মীদের আহ্বান করা। কর্মীরা ভুল ধরিয়ে দিলে তাদেরকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা করা অথবা ভুল স্বীকার করে নিয়ে পরবর্তীতে সংশোধন করা হবে বলে আশ্বাস দিলে কর্মীরা দায়িত্বশীলদের প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল ও বিশ্বস্ত হয়। সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বজায় থাকে। ইসলামী সমাজের বৈঠকগুলোতে এরূপ ব্যবস্থা আছে কি?

গবেষণাহীন নেতৃত্ব ও বইহীন সংগঠনঃ একজন মানুষ ইসলাম কায়েম করতে গেলে বাস্তবতার আলোকে সে প্রতিনিয়ত  অনেক সমস্যার সম্মোখীন হয়। আর তাকে এগুলো কাঁটিয়ে উঠতে তাৎক্ষনিক কিছু পদক্ষেপ ও কৌশল গ্রহণ করে থাকে এবং পরবর্তী দায়ীদেরকে এগুলো জানিয়ে যাওয়ার তীব্র আকাংখ্যা তার মধ্যে তৈরি হয়, যেন পরবর্তী জেনারেশন একই সমস্যায় পড়লে সহজেই মুক্তি পেয়ে যায়। এজন্য সে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে পরবর্তীদের জন্য বই লিখে থাকে। কিন্তু এখানে এমন নেতা পাওয়া মুশকিল। তারা বইয়ের কোন প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেন না। তাহলে তাদের কর্ম প্রচেষ্টার ও আন্তরিকতার প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট কারণ আছে। 

সৃজশীলতা বিবর্জিত দাওয়াতের পদ্ধতিঃ তারা কিছু ধরাবাধা কথা ও যুক্তির মারপেচ বলে যায়, চাই তা মানুষ বুঝোক আর না বুঝোক।  মানুষের যোগ্যতা বুঝে উপযুক্ত শব্দ চয়ন ও  কথা বলার যে বিষয়টা আছে তা তারা বুঝার চেষ্টা করেন না। 

শিক্ষার প্রতি অনীহাঃ  একজন শিক্ষিত নতুন কর্মীকে পরিকল্পিতভাবে দায়ী হিসেবে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা নেই। একাডেমিক শিক্ষার ব্যপারেও তারা উদাসীন। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। অথচ শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারূপ করেই ইসলামের সূচনা হয়েছে।

বেতনভুক্ত দায়ীঃ কোন নবী বা তার উম্মত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে বেতন নিয়ে পেইড দায়ী হিসেবে কাজ করতেন এমন কোন নজির ইতিহাসে পাওয়া যায় না। বরং সকল নবী এবং তার উম্মত দাওয়াতের কাজে জান প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন। কুরআনও দাওয়াতের ক্ষেত্রে এই কথাই বলে। কিন্তু আপনারা প্রফেশনাল দায়ী তৈরি করছেন। এই প্রফেশনাল দায়ীগণ কি জীবনের ঝুঁকি নিতে পারবেন? বিশেষ করে করে যারা প্রফেশন হিসেবেই এই কাজকে বেঁছে নিবে তারা কি বড় বিপদের সময় দল ছেড়ে পালাবে না? তাছাড়া রাষ্ট্র গঠনের পূর্বে এই বেতভুগী স্বার্থলোভী দায়ী তৈরির কোন দলীল কি আপনারা দেখাতে পারবেন?

বেতনভোগী দায়িত্বশীল তৈরির কুফলঃ

ক) জি-হুজুর মার্কা কর্মীঃ  অফিসের বস ও কর্মচারীর ন্যায় জি হুজুর মার্কা অনুগত ও গৃহপালিত কর্মী তৈরি হয়। যারা স্বার্থের কারনে ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলকে সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ দিতে ভয় পায়। ফলে দায়িত্বশীলদের পরিশুদ্ধির পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজন বেতভুক্ত অনুসারী কি নেতার ভুলগুলো নিঃস্বঙ্কচিত্ত্বে ধরিয়ে দিতে চাইবে? যেখানে স্বার্থ হারানোর শঙ্কা আছে? 

খ) নেতার সমালোচনার ভয় ও অন্ধ আনুগত্যঃ তারা রোবটের ন্যায় নেতার আনুগত্য করে। কারণ নেতার ভুল ধরলে যদি তার প্রতি বিরক্ত হয়ে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়, তাহলে তো সংসার চলবে না। তাছাড়া উপার্জনের অন্য কোন উপায় তো তার শেখা নেই।

গ) সমালোচনা গ্রহণে অনিহাঃ আমি তাদের ফেসবুক পেজে কয়েকটি স্থানে একটি দাওয়াতী নীতির বিপরীতে পরামর্শ দিয়েছিলাম। না কেউ পক্ষে কথা বলেছে, না বিপরীতে কোন কমেন্ট করেছে। ভাবখানা এমন যে, কি বলে আবার নেতার রোষানলে পড়ে যাই। নেতা যদি মন খারাপ করে দায়িত্ব থেকে বাদ দিয়ে দেয় তবে তো পেট চলবে না! তাই পক্ষে-বিপক্ষে কারও কোন বক্তব্য নেই। একদম দমবন্ধ। কিন্তু যে পোষ্টে কমেন্ট করেছিলাম তাদের সেই পোষ্টের পক্ষে ঠিকই কয়েকটি লাকই কমেন্ট পড়েছে।

ঘ) যোগ্য নেতা তৈরির ভয়ঃ কারণ তার চেয়ে বেশি যোগ্য নেতা তৈরি হলে স্বার্থে ভাগ বসাবে।

ঙ) পরিশ্রমবিমুখ ও বাস্তবতাবিবর্জিত কর্মী বাহিনী তৈরিঃ দাওয়াতী কাজ করেই যদি সংসার চালানো যায় তবে উপার্জনের মূল্য কি বুঝবে? দাওয়াতী কাজের দ্বীনী জজবা অনুধাবনের চেয়ে দুনিয়াবী স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন