শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদন্ড, তবে শিক্ষকগণ হলেন জাতির বিবেক। কেননা, শিক্ষকদের গঠনমূলক উপদেশ ও সততার শিক্ষার মাধ্যমেই একটি জাতির বিবেক গঠিত হয় এবং বিকাশ লাভ করে। প্রতিটি দায়িত্ববান শিক্ষকই ছাত্রদের জন্য শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু এবং শ্রদ্ধেয় অভিভাবক।
তবে কিছু কিছু শিক্ষক নিজ গুণ ও মহিমায় ছাত্রদের জন্য হয়ে উঠে প্রেরণার উৎস। তেমনি আমার ছাত্র জীবনের প্রেরণার বাতিঘর ছিলেন শ্রদ্ধাভাজন ও মান্যবর শিক্ষক মুহতারাম নূরুল আমীন হুজুর।
একজন শিক্ষকের মধ্যে যে গুণ ও বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা প্রয়োজন সেসবের যেন পরিপূর্ণ সমাবেশ ঘটেছিল তার মধ্যে। সততা ও নিষ্ঠায় যেমন তিনি ছিলেন অগ্রণী, আন্তরিকতা আর স্নেহ মমতায়ও ছিলেন অতুলনীয় একজন মানুষ। ন্যায়-নিষ্ঠার কঠোর অনুশীলনকারী একজন মানুষ হয়েও যে সকল শিক্ষার্থীর প্রিয় হওয়া যায় তা উনার জীবনী না দেখলে হয়তো বিশ্বাসও করতাম না।
কিন্তু আমি স্ব-চক্ষে এবং খুব কাছে থেকে উনার মধ্যে এই গুণগুলো দেখতে পেয়েছি। আমি দেখেছি, তিনি প্রতিটি মেধাবী শিক্ষার্থীর সাফল্যে কতটা আনন্দিত হতেন এবং একজন অভিভাবক ও পিতার ন্যায় কাছে টেনে নিয়ে গর্ব করতেন। এর ফলে তিনি অনায়াসেই মেধাবী ছাত্রদের অন্তরের মণিকোঠায় জায়গা করে নিতেন।
শুধু তাই নয়, এরূপ উৎসাহ দেখে দুর্বল ছাত্ররাও উৎসাহ পেতো এবং আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তো। আমি দেখেছি, তিনি ক্লাসে দেয়া উপদেশের মধ্যে দূর্বল ও উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রদের পক্ষে মজাদার উদাহরণ টেনে কিভাবে সবাইকে হাসির সাগরে ভাসিয়ে দিতেন।
ছাত্রদের প্রতিটি বিদায়ী অনুষ্ঠানে আমরা উনার বক্তব্যের অপেক্ষায় থাকতাম। বিদায়ী বক্তব্যে ছাত্রদেরকে উদ্দেশ্য করে একজন অভিভাবকের ন্যায় তার অন্তরের বিচ্ছেদ আর হাহাকারগুলো ফুটিয়ে তুলতেন, ফলে উপস্থিত ছাত্র-শিক্ষক আর অভিভাবকগণের মন বিগলিত হতো এবং চক্ষুগুলো অশ্রুধারায় সিক্ত হতো।
আমি দেখেছি, পরীক্ষার হলে উনি প্রবেশ করলে অসাধু শিক্ষার্থীরা কেমন উৎকন্ঠায় নিপতিত হতো এবং ভয়ে নিশ্চুপ হয়ে যেতো। তখন হলরুমে পিন পতন নিরবতা নেমে আসতো।ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা সস্থির নিঃস্বাস ছাড়তো।
পক্ষান্তরে খেলাধুলা আর পিকনিকের সময় তিনি দূর্বল শিক্ষার্থীদেরকে অগ্রাধিকার আর দায় দায়িত্বে প্রাধান্য দিয়ে মাতিয়ে রাখতেন, ফলে দূর্বল ছাত্ররাও তখন উনার চারপাশে কেমন আনন্দের সাথে একিত্রত হতো এবং দায়-দায়িত্ব পেয়ে উচ্ছাস আর গৌরব বোধ করতো। তখন তিনি খুব সহজেই দূর্বল ও উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠতেন।
তিনি তখন এতিমখানার ছাত্রদেরকে প্রাইভেট পড়াতেন এবং বোর্ডিংয়ের ছাত্রদের থোঁজ খবর রাখতেন। আমরা যখন কনকনে শীতের সকালে ফজরের নামাযের পর পড়তে বসতে বাধ্য হতাম এবং বসে বসে ঝিমাতাম। তখন সেই হারকাঁপা শীতের মধ্যে কিভাবে যে সাইকেল চালিয়ে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে সকাল সাতটায় উপস্থিত হয়ে যেতেন তা ভেবে এখনো অবাক হই।
তিনি আমাদেরকে বুঝাতেন, তোরা যে আজ বিচার নিয়ে এসে- আমার বেডে অমুকে ময়লা করেছে, আমার ফ্যান অতমুকে সেই করেছে বলে অভিযোগ করছস তা একদিন তোর থাকবে না, অন্য আরেকজন এসে দখল করে নেবে। তোদের চলে যাওয়ার কারণে মাদরাসার একটা ইটও ভাঙবে না, মাদরাসার কোনই সমস্যা হবে না। তাই সময় থাকতে মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করে যা। এগুলোই তোদের সাথে যাবে। পড়াশুনাই ভবিষ্যতে তোদেরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
তার দরদ মাখা কথাগুলো আজও অন্তরে মাঝে মাঝেই বেজে উঠে। তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, তোরা এই হেংলা পাতলা শিক্ষকটার মূল্য আজ বুঝলি না, আমার পরামর্শগুলোকে আজ গুরুত্ব দিলি না। একদিন ঠিকই বুঝবি, কিন্তু তখন বুঝলেও কোন লাভ হবে না।
তোরা হয়তো একদিন পড়াশুনা করে অনেক বড় হবি, বড় বড় যায়গায় চাকরি করবি, কিন্তু দেখিস এই হেংলা পাতলা শিক্ষকের মতো শুভাকাংখি আর কয়জনকে পাস। প্রিয় শিক্ষকের সেই দরদমাখা কথাগুলো স্মরণ হলে আজ চোখের কোণায় অশ্রু জমে উঠে।
কথাগুলো কতই না বাস্তব আর সত্য ছিল! উপদেশগুলো কতই না দামী ছিল! এরপর ঠিকই অনেক শিক্ষকের সান্বিধ্য পেয়েছি, কিন্তু সেই হেংলা পাতলা শিক্ষকের ন্যায় দরদী, আদর্শবান আর হিতাকাংখী আর দ্বিতীয় কাওকে পাইনি।
তাই আজ চিৎকার করে বলতে মনে চায়- হে শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক! হে প্রিয় উস্তাদ! হে দরদী অভিভাবক! আপনার কথাই সত্য ছিল! আপনার উপদেশগুলো কতই না দামী ছিল! আপনার স্নেহ-মমতা সত্যিই খুব অকৃত্রিম ছিল!
সত্যিই আপনাকে আমরা যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারিনি। কথাগুলো হয়তো সামনা সামনি মুখ ফুটে কখনো বলতেও পারবো না। ক্ষমা করবেন আমাকে ও আমারদেরকে।
রবের দরবারে হাজারবার দোয়া করি- আল্লাহ যেন আপনাকে ভালো রাখেন, সুস্থ রাখেন, নেক হায়াত দান করেন এবং ন্যায়ের পথে আজীবন অবিচল ও প্রতিষ্ঠিত রাখেন। আল্লাহুম্মা আমীন।
[লেখকঃ হাবিবুল্লাহ]
[দাখিলঃ ২০০৯ইং]
(13/08/2021)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন