কিছু বাস্তবতা কল্পনার চেয়েও অধিক ভয়ংকর
হয়ে থাকে। তেমনি এক ঘটনার স্বাক্ষী হলাম এক ডাক্তারের কথোপকথন শুনে। আমি তখন ময়মনসিংহের
চড়পাড়া মোড়ে একটি দোকানে টাইপিং এর কাজ করি। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ কাছাকাছি হওয়ায়
অধ্যয়নরত বা ছাত্র ডাক্তারগণ প্রায়ই আমাদের কাছে থিসিস তৈরির কাজে কম্পিউটার কম্পোজ
করাতে আসতো। তো একদিন এক ডাক্তার তার থিসিস টাইপিং করাতে আসলো আমার কাছে। যেহেতু থিসিসের
কাজ টানা ১০-১৫ দিন যাবত করতে হয়। তাই দিন দিন একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে।
তিনি তার ডিউটির ফাঁকে বিভিন্ন তথ্য অনলাইন থেকে বের করতে দোকানে এসে তাড়াহুড়ৃ শুরু
করে দিতেন। তবে লক্ষ করতাম, যত তাড়াহুড়ুই থাক না কেন তার স্ত্রী ফোন করার সাথে সাথে
রিসিভ করে কথা বলা শরু করতেন। দেখতাম তার স্ত্রী প্রায় সময়ই অযথা ও অপ্রয়োজনীয় কথাই
বলতো- যেমন: এখন কোথায় আছ, কি করছ, তোমার মেয়ে কি বলছে শোন এই বলে মেয়ের কাছে ফোন দিত
আর তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মেয়ের সাথে অযথা কিছু কথাবার্তা চালিয়ে যেতেন।
ফোন রেখে
দিয়ে কাঁদু কাঁদু স্বরে বলতেন, দেখেন তো! এই গুরুত্ব পূর্ণ সময়টা সে কিভাবে নষ্ট করে
দিল! আমি ডিউটি ফেলে থিসিস তৈরির কাজে এসেছি এই সময় ফোন দিয়ে কতটুকু সময় নষ্ট করে দিল।ইস!
এগুলোর আর সহ্য হয় না! আমি বললাম, আপনি আপনার স্ত্রীকে কেন ধমক দিচ্ছে না? আর ফোন দেওয়ার
সাথে সাথে ধরতেই হবে কেন? তিনি বলতেন, সর্বনাশ! এটা করলে তো সে আমাকে একদম শায়েস্তা
করে ছাড়বে। জানেন না এই মহিল কত ভয়ংকর!
কিন্তু এর মাথামু্ন্ডু কিছুই বুঝতাম না। আর
এগুলো বুঝার চেষ্টাও করতাম না, যেহেতু এগুলো তাদের পারিবারিক বিষয়।তার পোষ্টিং ছিল
নান্দাইল সদর হাসপাতালে। কিন্তু যেহেতু তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র এবং এখানেই
তার থিসিস জমা দিতে হয় তাই আমাদের কাছে তার থিসিস করা। একদিন তিনি আমাকে বললেন, আগামী
কাল যেহেতু শ্রুক্রবার, আর আপনাদের দোকান যেহেতু শুক্রবারে বন্ধ থাকে তাই কাল ভোরেই
নান্দাইল চলে যাবেন। সেখানে আমার পরিচিত এক কম্পিউটার দোকানে কথা বলা আছে, সেখানে আপনি
কাজ করবেন, আর আমিও সেখানে সময় দিতে পারবো।
এই বলে বলে আমার হাতে কিছু টাকা ভাড়া হিসেবে ধরিয়ে দিল। আমি আর কথা বলার সুযোগ
পেলাম না।
যথারীতি পরদিন প্রায় ভোর ৭ টার দিকে উপস্থিত হলাম নান্দাইল সদর হাসপাতালে।
কিন্তু তখন হাসপাতাল বা কম্পিউটারের দোকান কোনকিছুই খোলা নেই। তাই এক চায়ের দোকানে
লম্বা একটা সময় পার করলাম তার সাথে বসে। এর ফাঁকে আলাপ আলোচনায় তিনি তার জীবনের ঘটনাগুলো
বলে ফেললেন। বললেন, আমি হলাম পরিবারের ছোট ছেলে। আমাদের ছোট রেখেই পিতা মারা যান। আমার
পড়াশুনার যাবতীয় খরচ বহন করতেন আমার ছোট ভাই। কিন্তু মেডিকেলে ভর্তি হয়ে জীবনের চুড়ান্ত
একটি ভুল করে বসলাম। বাড়ির কাওকে না জানিয়ে এক প্রভাবশালী লোকের ক্লাসমেট মেয়েকে প্রেমের
ফাঁদে পড়ে বিয়ে করে ফেললাম।
এতে আমার পরিবার আমার প্রতি চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে যোগাযোগ
বন্ধ করে দিল। সবচেয়ে খারাপ লাগে এটা ভেবে, যে ভাই আমার জন্য এতকিছু করল তাকে চরমভাবে
হতাশ করে দিলাম। আমার পকেটের একটা টাকা দিয়েও তাকে সহযোগিতা কারার সুযোগ পেলাম না।
সে এখন আমার প্রতি চরম বিরক্ত। মা’কে সহযোগীতা করবো সেই উপায়ও নেই। বিয়ের পর থেকে বাড়িতে
যাওয়ার মুখই নেই আমার। আর এদিকে বিয়ের পর বুঝতে পারলাম যার জন্য পরিবার থেকে বিতাড়িতে
হলাম সে একটা আজদাহা শাপ ভিন্ন কিছু নয়।
কথা বার্তায় চরম কর্কশ! সর্বদা ধমকের উপর রাখে।
তার বাবা একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি। তাকে যে ধমক দিয়ে কিছু বলবো সে উপায়ও নেই।
ছেড়ে দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এখন হয়তো মা এবং ভাইয়েরা ভাবছে আমি বড় সুখে আছি। কিন্তু
আমি যে এতবড় সমস্যায় আছি তা তারা জানেও না আর আমি যে তাদেরকে জানাবো সেই মুখও আমার
নেই।
একটা মাত্র ভুল সিদ্ধান্তের কারনে আজ আমার জীবণ জাহান্নামের চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
কি করবো? কোথায় যাব? কিছুই বুঝতে পারি না। এ জীবনে শান্তির দেখা পাবো- এরকম কোন পথও
আমি খোজে পাই না।
আমি ব্যর্থ! আমি দূর্ভাগা! কিন্তু এই কথাটা কাওকে যে মন খোলে বলব
এই পরিস্থিতিও আমার নেই। সবাই মনে করছে, একজন ডাক্তার! তার মনেহয় সুখের সীমা নেই। মানুষ
যথেষ্ট সম্মানও করে বটে। কিন্তু আমি তো সুখে নেই! এই জীবনকে কি বেঁচে থাকা বলা যায়?
আমার জীবনটা এখন মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রণাময় হয়ে দাড়িয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন