ভূমিকাঃ সালাম ইসলামের এক সুন্দরতম অভিবাদন পদ্ধতি। পৃথিবীতে অসংখ্য ধর্ম এবং
সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান। সকল ধর্ম এবং সমাজ ব্যবস্থাতেই ভিন্ন ভিন্ন অভিবাদন
পদ্ধতি রয়েছে। অর্থের বিচারে সকল অভিবাদনের মধ্যে সালামের চেয়ে সুন্দর কোন অভিবাদন
খুঁজে পাওয়া কঠিণ। প্রকৃতপক্ষে সালামের মত বা এর কাছাছাছিও কোন অভিবাদন খুঁজে
পাওয়া যাবে না। সালামের অনেক উপকারিতা আছে। হজরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) বর্ণনা করেন, একবার এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) এর কাছে এসে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম (যেহেতু সাথে আন্যান্য সাহাবী উপস্থি ছিল)।’ তখন তিনি সালামের উত্তর
দিলেন এবং বললেন, লোকটির জন্য ১০টি নেকি লেখা হয়েছে। এরপর অন্য এক ব্যক্তি এসে
বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ (একটু বাড়িয়ে)।’ তখন আল্লাহর রাসূল
(সাঃ) তার সালামের জবাব দিয়ে বললেন, তার জন্য ২০ টি নেকি লেখা হয়েছে। এরপর অন্য এক
সাহাবী এসে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ও বারাকাতুহ (আরও একটি
শব্দ বাড়িয়ে)।’ তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার (সালামের) উত্তর দিয়ে বললেন, লোকটির
জন্য ৩০টি নেকি লেখা হয়েছে। (সুনানে তিরমিজি-২৬৯০)
ইমাম তিরমিজি (রহঃ) এই হাদিসের মান “হাসান” বলেছেন।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে প্রচলিত সালাম উচ্চারণগত, প্রচলণগত এবং বচনগতভাবে ভুল।
নিম্নে বিষয়গুলো নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা তুলে ধরা হলো-
বচনগত ভুল: বাংলার মত
আরবীতেও বচনগত পার্থক্য আছে। বাংলায় যেমন উপস্থিত একজন ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে
কিছু বলতে গেলে ব্যবহার করতে হয়- তুই,তুমি বা আপনি। ঠিক তেমনি আরবিতে বলতে হয় কা (পুরুষ)/কি (মহিলা)। যেমন-
১। মা ইসমুকা?- তোমার নাম কী? এখানে “কা” দ্বারা একজন পুরুষকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে।
অনুরূপ সালামের ক্ষেত্রে বলতে হয়- আসসালামু আলাইকা। যেমন-
২। আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ- হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আপনার উপর শা্ন্তি বর্ষিত
হোক।
৩। আসালামু আলাইকা ইয়া
খালিদ- হে খালিদ! তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।
হাদিসের দলিল: জাবির ইবনু সুলাইম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললাম, ‘আলায়কাস সালাম’। তিনি বললেন, ‘আলায়কাস সালাম’ বল না, বরং ‘আসসালামু আলায়কা’ বল। (তিরমিযী হা/২৭২২, সনদ ছহীহ।)
৪। কোন মহিলার নাম জিজ্ঞাসা করা হলে আরবীতে বলতে হয়-
মা ইসমুকি?- তোমার (একজন মহিলা) নাম কী?
৫। একজন মহিলাকে সালাম দিতে বলতে হয়-
আসসালামু আলাইকি- আপনার
(একজন মহিলা) উপর শান্তি বার্ষিত হোক।
সুতরাং আরবি ব্যকরণের দৃষ্টিতে এবং ইসলামের দৃষ্টিতে শুদ্ধরূপে একজন
পুরুষকে সালাম দিতে আমাদের বলা উচিত-
“আসসালামু আলাইকা”- আপনার (একজন পুরুষ) উপর শান্তি বর্ষিত
হোক।
আর একজন মহিলাকে সালাম দিতে বলতে হবে-
আসাসালামু আলাইকি- আপনার
(একজন মহিলা) উপর শান্তি বর্ষিত হোক।
আরবিতে বচন তিন প্রকার। যথা- ১. এক বচন, ২. দ্বিবচন, ৩. বহুবচন|
দুইজন পুরুষ বা মহিলাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে হলে আরবীতে- কুমা শব্দটি ব্যবহার করতে হয়। যেমন-
১. মা ইসমুকুমা?-
তোমাদের দুইজনের (পুরুষ/মহিলা) নাম কী?
২. আসসালামু আলাইকুমা-
তোমাদের দুইজনের উপর (পুরুষ/মহিলা) শান্তি বর্ষিত হোক।
অনুরূপ দুইয়ের অধিক পুরুষ বা মহিলাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে গেলে- কুম শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যেমন-
১. কাইফা হালুকুম?-
তোমরা (দুইয়ের অধিক পুরুষ/স্ত্রী) কেমন আছ?
২. “আসসালামু আলাইকুম”-
আপনাদের (দুইয়ের অধিক পুরুষ/স্ত্রী) উপর শান্তি বর্ষিত হোক।
সালামের ভুল অর্থ ও ভুল ব্যাখ্যাঃ আমাদের দেশে
আসসালামু আলাইকুম- এর অর্থ -আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক অনুবাদ করা
হয়, যা অর্থগতভাবে মারাত্মক ভুল। এর সঠিক অর্থ হবে আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তাছাড়া এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়-
মানুষ ছাড়াও সাথে ফেরেশতা থাকে তাদেরকে একসাথে বহুবচন ধরা হয়- এটা গুজামিল ধরনের
ব্যাখ্যা, যার সাথে ইসলামী ব্যাখ্যা বা কালচারের কোন সম্পর্ক নেই। কেননা রাসূল
(সাঃ) এর যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আরব রাষ্ট্রগুলোতে সালামের ক্ষেত্রে
উপরোল্লিখিত বচনগত ও ব্যকরণগত পার্থক্য বজায় রেখেই আরবের সাধারণ মানুষ সালাম
প্রদান ও এর জবাব দিয়ে আসছে।
আলোচনা সংক্ষেপঃ সালামের বচনগত
আলোচনার মাধ্যমে পরিষ্কার হলো যে, বচনগত দিক থেকে সালামের শুদ্ধ উচ্চারণ চারটি।
যথা-
১। “আসসালামু আলাইকা”- আপনার (একজন পুরুষ) উপর শান্তি বর্ষিত
হোক।
২। “আসাসালামু আলাইকি”-
আপনার (একজন মহিলা) উপর শান্তি বর্ষিত হোক।
৩। “আসসালামু আলাইকুমা”-
তোমাদের দুইজনের উপর (পুরুষ/মহিলা) শান্তি বর্ষিত হোক।
৪। “আসসালামু আলাইকুম”-
আপনাদের (দুইয়ের অধিক পুরুষ/স্ত্রী) উপর শান্তি বর্ষিত হোক।
সালামের জবাবঃ সালাম দাতার সংখ্যার ভিত্তিতে এর জবাবও হবে
অনুরূপ চারটি। যথা-
১। “ওয়া আলাইকাস সালাম”- আপনার (একজন পুরুষ) উপরও শান্তি
বর্ষিত হোক।
২। “ওয়া আলাইকিস সালাম”-
আপনার (একজন মহিলা) উপরও শান্তি বর্ষিত হোক।
৩। “ওয়া আলাইকুমাস সালাম”-
তোমাদের দুইজনের উপরও (পুরুষ/মহিলা) শান্তি বর্ষিত হোক।
৪। ওয়া আলাইকুমুস সালাম”-
আপনাদের (দুইয়ের অধিক পুরুষ/স্ত্রী) উপরও শান্তি বর্ষিত হোক।
সালামে আরও কিছু
ভুলঃ আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সালামের ক্ষেত্রে
জেনে বা না জেনে উচ্চারগতভাবে ভুল করে থাকেন। যার মাধ্যমে সওয়াবের পরিবর্তে গুণাহের
আশঙ্কা রয়ে যায়। যেমন- স্লামালেকুম, আস লামু আলাইকুম ইত্যাদি। আবার কেউ কেউ এই ভুল
সালামগুলোকে সালামের আধুনিক স্টাইল বা অফিসিয়াল সালাম হিসেবে আখ্যায়িত করে আত্মতুষ্টি
অনুভব করেন, যা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। কারণ, জেনে-শুনে এরকম ভুল সালামকারী সওয়াব তো
পাবেই না বরং উল্টো গুণাহগার হবেন। তাই আমাদের উচিত সালামের ক্ষেত্রে বিকৃত উচ্চারণ
পরিহার করে শুদ্ধ উচ্চারণে সালাম দেওয়া এবং বিকৃত উচ্চারণে সালামকারীদেরকে সতর্ক করা।
সালামে হাত উঠানোঃ
সালাম দেওয়ার সময় অনেকে হাত তুলে থাকেন। এটাও
উচিত নয়। সালাম দেওয়ার সময় অযথা হাত উঠানোর প্রয়োজন নেই। তবে যারা বধির বা কানে কম
শুনেন তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হাত উঠানো যেতে পারে।
কথার মাঝখানে সালামঃ বিভিন্ন সভা, সেমিনার বা ওয়াজ মাহফিলে দেখা যায় সভাপতি, সেক্রেটারী এবং সাধারণ মুসল্লিদেরকে উদ্দেশ্য করে সুদীর্ঘ সময় ক্ষেপন করে তারপর সালাম দেওয়া হয়। সালামের এই পদ্ধতিটিও একটি ভুল পদ্ধতি। সুন্নাহ সম্মত সঠিক পদ্ধতি হলো শুরুতেই সালাম দিয়ে তারপর কথাবলা শুরু করা।
শেষকথাঃ সালাম ইসামের গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্ভাষাণ। তাই আমাদের উচিত এর ত্রুটিগুলো
পারিহার করে বচনগত ও উচ্চারণত দিক সঠিক রেখে সালাম প্রদান করা। এক্ষেত্রে শিক্ষিত মানুষদের
উচিত সালামের উপরোল্লিখিত সঠিক পদ্ধতিগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরা এবং প্রচলিত ভুল
পদ্ধতিগুলো মানুষদেরকে পরিহারের পরামর্শ প্রদান করা। এতেকরে আমাদের অগণিত সওয়াবের অধিকারী
হওয়ারও বিশেষ সুযোগ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক পদ্ধতিতে সলামের প্রচলন ও প্রচার
করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন