রবিবার, ২২ মে, ২০২২

মসজিদগুলোর উন্নতি যখন মানবিক অবনতির কারণ


ভূমিকা: হাদিসে বর্ণিত আছে- ইমাম বুখারী (রঃ) আনাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করে বলেনঃ ‘‘লোকেরা মসজিদ নিয়ে গর্ব করবে, কিন্তু ইবাদতের মাধ্যমে তা আবাদ করবেনা’’ (বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুস্ সালাত)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেনঃ ‘‘যত দিন লোকেরা মসজিদ নিয়ে গর্ব না করবে ততদিন কিয়ামত হবেনা’’। (মুসনাদে আহমাদ। ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেন, সহীহুল জামে, হাদীছ নং- ৭২৯৮) হযরত উমার (রাঃ) মসজিদকে জাঁকজমক করতে নিষেধ করেছেন (ফাতহুল বারী, (১/৫৩৯) । কিন্তু আজকাল দেখা যায় মানুষেরা মসজিদে সালাত আদায়ের চেয়ে মসজিদগুলোকে চাকচিক্য করতে প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে।  এর পরিণতিতে সাধারণ মানুষেরা হচ্ছে ভোক্তভোগি এবং হয়রানির স্বীকার। এ বিষয়ে আমার দেখা কয়েকটি তিক্ত অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই-

সালাত আদায়ে বাঁধা: আমি ময়মনসিংহের চরপাড়াতে দীর্ধদিন যাবত কর্মরত আছি। প্রায়ই দিনের অধিকাংশ সালাত চরপাড়া মুড়ের সন্বিকটে অবস্থিত বকুলতলা মসজিদে আদায় করতাম। একদিন জোহর কি আসরের সালাত আদায় করতে গিয়ে দেখলাম এক মুরুব্বি একজন ৩০-৩৫ বয়সী শ্রমিককে ধমকিয়ে মসজিদ থেকে বের করে দিচ্ছে। কারণ সে ঘষার কাজ করতেছিল। একারণে তার গায়ে ধুলোবালির চিহ্ন ছিল। তাদের কথাবার্তা কিছুটা এধরনের ছিল-

- এই! বের হ এখান থেকে, এখই বের হ! ময়লা দিয়ে বসার জায়গা নষ্ট করে ফেলছস দেখছি। তাড়াতাড়ি বের হ!

- আমার গায়ে তো ময়লা নেই আঙ্কেল । আমি বাহির থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসেছি। হাত পা শুকিয়ে এমন ময়লা ময়লা দেখা যাচ্ছে। আমার গায়ে ময়লা নেই।

- আরে তুই বের হ আগে! গায়ে ময়লা মেখে আবার তর্ক করতে এসেছে! বের হ বলছি, বের হ!

ঘটনাটা দেখে খুবই মর্মাহত হলাম। কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে বের করে দিচ্ছে। উপায়ন্তুর না দেখে ঐ সালাত আদায়কারী ভাইকে বললাম- ভাই, জামিয়া ইসলামিয়াতে চলে যান- মাদরাসার মসজিদটি ঐদিকে। মসজিদ চকচকে হওয়ায় সাধারণ মানুষেরা আজ মসজিদের অযুখানা পর্যন্তও যাওয়ার অনুমতি পাচ্ছে না। তাহলে তারা মসজিদে গিয়ে জামায়াতে সালাত আদায় করবে কিভাবে?

অসম্ভব প্রতারণা: আমার বাড়ি শেরপুর জেলায় অবস্থিত। প্রায় দশ বছর যাবৎ ময়মনসিংহে অবস্থান করছি। শেরপুর থেকে ময়মনসিংহে যাতায়াতের পথে প্রস্রাবের বেগ পেলে সাধারণত আশপাশের মসজিদ তালাশ করি। কারণ একজন সালাত আদায়কারীকে প্রয়োজন পূরণের সাথে সাথে পবিত্রতাও অর্জন করতে হয়।

 

কিন্তু দীর্ঘদিন যাতায়াতের ফলে লক্ষ করলাম, দিন দিন যতই মসজিদ ও তার প্রস্রাব পায়খানার ব্যবস্থা উন্নত হচ্ছে ততই সেগুলো তালাবদ্ধ হচ্ছে। আচ্ছা, এভাবে মসজিদের জরুরত পূরণের জায়গাগুলো তালাবদ্ধ হয়ে পড়লে একজন সাধারণ মুসল্লি তার প্রয়োজন কোথায় সাড়বে? পবিত্রতা কিভাবে অর্জন করবে? তবে একটা জিনিস দেখলাম খুব বাড়ছে।

 

প্রতিবার যাতায়াতের পথে মসজিদের কালেকশনের হিড়িক এবং দান খয়ারাতে সওয়াবের মাহাত্ম বর্ণনা। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রস্রাব পায়খানার মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখাও যে সওয়াবের কাজ সেটা তারা বুঝতে চায় না। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এগুলো নির্মাণের টাকা নিয়ে তাদের ব্যবহার ঠেকাতেই এগুলোতে তালা ঝুলিয়ে রাখা অথবা ৫ টাকা/১০ টাকা ট্যাক্স নির্ধারণ করা কত বড় প্রতারণা আর অন্যায় তা তারা একবারের জন্যও চিন্তা করে না।

 

একটি চাক্ষুস অবনতির স্বাক্ষি: আমার বাড়ি শেরপুর জেলার গাজির খামার ইউনিয়নে। বাড়িতে গেলে সাধারণত গাজির খামার বাজারেই কেনাকাটা করতে আসি এবং বাজারের মসজিদে সালাত আদায় করি। পূর্বে বাজারের মসজিদটি তেমন উন্নত ছিল না। অনুরূপ প্রস্রাব পায়খানার ব্যবস্থাও ছিল অনুন্নত। কিন্তু তখন সেই ভাঙ্গা ব্যবস্থাগুলোই মানুষের জরুরত পূরণে ব্যপক সহায়ক ছিল।

 

কিন্তু বর্তমানের অবস্থা একেবারেই পাল্টে গেছে। আমার পূর্ব পরিচিত হিরা ভাই মসজিদের ইমাম নিযুক্ত হওয়ার পর মসজিদের উন্নয়নে ব্যপক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। বাজারের চার রাস্তার মুড়ে একেবার তাবু টানিয়ে ঈদ, রোজা এবং বাজারের দিনগুলো ছাড়াও মাঝে মাঝে একাধারে কালেকশন শুরু করলেন। এতে প্রচুর কালেকশন হলো এবং মসজিদ উন্নয়নের পাশাপাশি সারি সারি টয়লেট এবং প্রস্রাবখানার ব্যবস্থা হলো। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, এগুলো ময়লা করে ফেলার অযুহাতে এখন (সালাত আদায়কালীন সময় ব্যতীত) সর্বদা তালাবদ্ধ থাকে।

 

একদিন বাজারে গিয়ে টয়লেটের খুব বেগ পেল। গিয়ে দেখলাম সেগুলো তালাবদ্ধ। প্রচুর চাপ পেয়েছে। যেকোন সময় অবস্থা বেগতিক হতে পারে। তাই হন্তদন্ত হয়ে মসজিদের খাদেমকে বের করলাম এবং বললাম এগুলো খোলা রাখা যায় না? খাদেম এবং তার সাথে তাল মিলিয়ে আরেক মুরুব্বি আমাকে প্রায় ধমকের সুরে বলল, আরে এগুলো খোলা রাখলে সবাই তো ময়লা করে চলে যায়। এগুলো পরিষ্কার করবে কে?

 

সাধারণ মানুষকে সওয়াবের লোভ দেখিয়ে তাদের পকেটের টাকা নিয়ে এখন সেগুলো ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করছে সাধারণ মানুষের উপরই। এগুলো দেখে আফসোস করা ছাড়া আর উপায় কি?


উপসংহার: এক সময় মসজিদ এবং এর ব্যবস্থাপনাগুলো অনুন্নত থাকলেও সাধারণ মানুষের ব্যপক কাজে আসতো, কিন্তু মসজিদ ও তার ব্যবস্থাপনাগুলো দিন দিন যতই উন্নত হচ্ছে, ততই সাধারণ মানুষ ও দরিদ্র মানুষগুলো এর উপকারিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং হয়রানির স্বীকার হচ্ছে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন