আজ আমাদেরকে আপনার হাত হারানোর গল্পটি বলুন। শিক্ষক প্রশিক্ষণের শেষ দিন সকল শিক্ষক মিলে শায়লাকে অনুরোধ করল। সবার অনুরোধে শায়লা বলতে লাগল-
আমি তখন অনেক ছোট। আমার পিতা মাতার মাঝে সব সময় ঝগড়া লেগেই থাকতো। এই ঝগড়া একসময় বাড়তে বাড়তে দুই পরিবারের মাঝে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় । ফলে একসময় তা বিচ্ছেদে রূপ নেয়। একদিন আমার নানা ও মামারা মিলে আমাদের বাড়িতে আসে মীমাংসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু দুই পক্ষের বাড়াবাড়ির কারণে ঝগড়া এতই তিক্ততায় পৌঁছে যে, আমার পিতা ঐ বৈঠকেই আমার মাকে তালাক দিয়ে দেয়। তালাক দেওয়ার পর বাধে আমাকে নিয়ে ঝগড়া, দাদা বলে আমার নাতি আমার কাছেই থাকবে। নানা বলে না, নাতি তোমার নয়, এটা আমার নাতি।
নাতিকে
আমিই সাথে নিয়ে যাব। এই বলে নানা আমার হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। তৎক্ষনাত দাদু আমার হাত ধরে টানতে থাকে এবং বলে না তুই আমার নাতিকে আমার বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে পারবি না। এভাবে দুজনেই আমার হাত ধরে পালাক্রমে হেচকা টান দিতে থাকে। ওদিকে অসহ্য যন্ত্রণায় আমি মরণ চিৎকার দিয়ে উঠি। কিন্তু আমার চিৎকারের দিকে কারও যেন পরোয়া নেই। বাড়ির অন্য সবাই নিরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। পিতা-মাতাও মূর্তীর মতো দাড়িয়ে রইল। আমার যে ব্যথায় প্রাণ প্রায় উষ্ঠাগত সেদিকে কারও দৃষ্টি নেই। আমার জানের দিকে যেন দয়া দেখাবার মতো কারও বিবেক নেই। সবার বিবেক যেন আজ মরে গেছে। তখন আমার কাছে মনে হলো- যেন এই দুনিয়ায় মানুষের কোন অস্তিত্বই নেই। সবাই যেন জানোয়ার হয়ে গেছে। এভাবে দুই পক্ষ আমার দুই হাত ধরে হেচকা টানতে টানতে আমার একটি হাত শেষ পর্যন্ত ছিড়েই ফেলল। ঘটনাটি শুনে বেদনায় শিক্ষকদের চোখ বেয়ে অশ্রুধারা বইতে লাগলো।
শায়লা আবার বলতে লাগলো-
আমার
নানা ঐ ছেড়া হাত আর আমার মাকে নিয়ে তার বাড়িতে চলে গেল। আমার বাবা ও দাদু আমাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলো। এভাবে অনেকদিন কষ্ট ভোগ করে একসময় আমার ক্ষত সেরে উঠলো। কিন্তু মনের ক্ষত আর হাত হারানোর বেদনা আজও বয়ে চলছি। আমার হাতটি তো আর ফিরে পেলাম না। দাদু ও পিতার আদর যদিও কম ছিল না তবুও তাদেরকে মন থেকে কখনোই আর ক্ষমা করতে পারিনি। আমি সেড়ে উঠার সাথে সাথেই প্রতিজ্ঞা করলাম- আমি একজন শিক্ষক হবো। কেননা শিক্ষার অভাবেই এসব গ্রাম্য লোকেরা প্রতিহিংসার বসবর্তী হয়ে পশুর কাতারে নেমে আসে। আমি মনেকরি সত্যিকারের শিক্ষা থাকলে কোন মানুষ এরকম জঘন্য কাজ করতে সাহস পাবে না। তাই আজ আমি শিক্ষক বা মানুষ গড়ার কারিগর হয়েছি।
-
সবাই সমস্বরে বলে উঠলো- আপনি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। সঠিক শিক্ষা পেলে মানুষ এতটা জঘন্য হতে পারবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন