নাবিল সবেমাত্র ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছে। তাদের সংসারে সে এবং তার বাবা মা ছাড়া আর কেউ নেই। সর্বদা তাদের সংসারে দরিদ্রতারে দৈন্যদশা লেগেই থাকে। তার বাবার শারীরিক অবস্থা ইদানিং ভালো যাচ্ছে না। তিনি প্রায়ই বুকের ব্যথায় ভোগেন। ব্যথা বেড়ে গেলে গ্রামের ফর্মেসী থেকে ঔষধ কিনে খান। প্রতিবেশীরা বলেন, বুকের ব্যথা নিয়ে এভাবে বসে থাকলে কী হবে? ভালো একজন ডাক্তার দেখান, নয়তো ব্যথা আরও বেড়ে যাবে। কিন্তু তিনি ডাক্তার দেখাতে সাহস পান না। এমনিতেই সংসারের যা অবস্থা। তাছাড়া ছেলেকেও পড়ার খরচ দিতে হয়। এর মধ্যে ডাক্তার দেখাবার টাকা কই। এসব চিন্তা করে ব্যথা নিয়েই বসে থাকেন। কিন্তু রোগ বলে কথা। রোগ তো আর টাকা পয়সা দেখে না। চিকিৎসা না নেওয়ায় দিন দিন তার ব্যথা বড়তেই থাকল। একদিন ব্যথা এতই বেড়ে গেলো যে বিছানা থেকে উঠতেই পারছেনা। এমনকি ঠিকমত কথাও বলতে পারছেন না। এ অবস্থা থেকে নাবিলের মা কান্নাকাটি শুরু করে দিল। তার কান্নার আওয়াজ শুনে প্রতিবেশীরা ছোটে আসল। সবাই বলল রোগীকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভর্তি করান। নয়তো অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাই দ্রুত এম্বুলেন্স সংগ্র করা হলো এবং সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। রোগীর অবস্থা বেগতিক দেখে ডাক্তারগণ ঢাকায় রেফার্ড করে দিলেন। নাবিলের মার যেন আকাশ ভেঙ্গে মাথায় পড়ল। টাকা পয়সা নেই তাছাড়া ঢাকায় চেনাজানা কোনো লোকও নেই। নাবিল এদিক সেদিক ফোন দিয়ে ঢাকায় কোন আত্মীয় আছে কি-না তার সন্ধান করতে থাকল। খুঁজতে খুঁজতে দূরবর্তী এক খালাতো বোনের সন্ধান পেল। যারা অনেক দিন থেকেই ঢাকায় থাকে তাও আবার ঢাকা সদর হাসপাতাল থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। তাদেরকে সব খুলে বলে তার বাবাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলো। ঢাকা সদর হাসপাতালে তারা পৌছালে দেখতে পেলো তার সেই খালাতো বোন এবং দোলাভাই তাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। রোগীকে গাড়ী থেকে নামিয়ে তার দোলাভাই তাদেরকে সাথে নিয়ে কোথায় ভর্তি করাতে হয়ে কিভাবে কী করতে হবে সব ব্যবস্থা করে দিলেন। এসব করতে করতে রাত বারটা বেজে গেলো। তখন তার দুলাভাই এবং বোন চলে যেতে চাইল সাথে নাবিলকেও যাওয়ার জন্য বলল। নাবিল বলল আজ যেতে পারছি না। মা একা সামলাতে পারবে না। তিনি কখনো ঢাকায় আসেননি। তাই কোন কিছুর প্রয়োজন হলে কই যাবে কী করবেন তা বুঝতে পারবে না। পরদিন তার দুলাভাই তাদের জন্য খাবার নিয়ে আসলো। খাওয়া শেষে আদিলকে বলল, চল আমাদের বাসাটা দেখাই। সমস্যা হলে যেন যেতে পার। তার মাও সায় দিয়ে বলল, যা বাসাটা চিনে আয়। তাই আদিল তার দুলাভাইয়ের সাথে তাদের বাসায় গেল। এক রাতে রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলো। ইতিমধ্যে তার মা হাসপাতালের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। তাছাড়া তার বাবার রোগও কিছুটা কমে এসেছে। আর ওদিক থেকে প্রাই তার দুলাভাই রাতে তাদের বাসায় গিয়ে ঘুমাতে বলে। আজ বিকালে তার বোন তাকে বাসায় এসে থেকে যেতে বলল। মাকে বলাতে মা বলল যা কয়েকটা দিন তো খুব কষ্ট করলি আজ না হয় তোর বোনের বাসায় গিয়ে একটু শান্তিতে ঘুমিয় আয়। আদিল চিন্তা করল রাতে ডাক্তারদের ভিজিটের পরই চলে যাবে। ডাক্তারদের ভিজিট শেষ হতে হতে রাত এগারোটা বেজে গেলো। মা বলল, এতরাতে এখন আর যাওয়ার দরকার নেই। আদিলেরও মন চাইছে না। কিন্তু সে যেহেতু কথা দিয়ে ফেলেছে তাই সে তার মাকে বলল, মা আমার জন্য আপু অপেক্ষায় আছেন তাই আমাকে আজ যেতেই হবে। এই বলে সে অনিচ্ছ সেত্বেও মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।
কিছুটা পথ গাড়িতে এসে নেমে পড়ল। তারপর একটা রিক্সাকে ডেকে বলল মামা, সামনের তিন নাম্বার গলিতে নামলে ভাড়া কত নিবেন। রিক্সাওয়ালা বলল মামা ত্রিশ টাকা দিতে হবে। এত বেশি ভাড়ার কথা শুনে সে বল ঠিক আছে আমি তাহলে হেটেই যাবো। এই বলে সে হাটা শুরু করল। রাত এখন প্রায় বারোটা বেজে গেছে। এখান থেকে প্রায় বিশ মিটি তাকে হেঁটে যেতে হবে। ঢাকা শহরে সে এর আগে কখনো আসেনি। তাছাড়া এই এত রাতে একলা হাটছে এটা ভেবে তার মনে কিছুটা ভয়ও করছে। সে ভাবছে যদি কোন ডাকাত তাকে ধরে তাহলে সে কী করবে। এই চিন্তা করে ভয়ে ভয়ে রাস্তা হাঁটছে। প্রায় পাঁচ মিনিট হাঁটার পর হঠাৎ তাকে দেখে একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। কুকুরের চিৎকার শুনে তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। সে থমকে দাঁড়াল। কুকুর ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছে। সে মাথা ঠান্ডা রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সে ভাবছে যদি পালানোর জন্য দৌড় দেই তাহলে কুকুর এসে কামড়িয়ে ধরবে। তাছাড়া সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকাও সম্ভব নয়। তাই সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এই ভেবে আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। তার সামনে অগ্রসর হওয়া দেখে কুকুর আরও উচ্চ শব্দে ঘেউ ঘেউ করতে থাকলো। কুকুরের সেই আওয়াজ শুনে দূরের আরও কয়েকটি কুকুর ছোটে আসলো। এই দৃশ্য দেখে তার মাথা তালগুল পাকিয়ে গেলো। কী করবে এখন? ভয়ে যেন দেহ থেকে আত্মা বেরিয়ে যাচ্ছে। আজ যেন বিপদ তাকে চারদিকে থেকে ঘিরে ধরেছে। ভয়ে তার শরীরটা ঝাকুনি দিয়ে কাঁপা শুরু করে দিয়েছে। এখন চারদিক থেকে প্রায় দশ বারোটা কুকুর এসে তাকে ঘিরে প্রচণ্ড শব্দে ঘেউ ঘেউ করে কাঁছে আসতে আসতে আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। কুকুরগুলোর চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। ভয়ে তার ঠোট মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কিন্তু তাকে এখন বাঁচতে হবে। এই চিন্তা করে সে এক বুদ্ধি বের করল। যেহেতু কুকুরগুলো এখনো তাকে কামড় দিতে সাহস পাচ্ছে না। তাই একটু একটু করে আগ বাড়াতে হবে। দাঁড়িয়ে থাকলে কোন উপায় হবে। এই ভেবে সে দুই কদম সামনে আগাল। দেখল পিছনের কুকুরগুলো তাকে কামড়াবার জন্য ঘেউ ঘেউ করে এগিয়ে আসছে। এটা দেখে সে থমকে দাড়িয়ে গেল। কুকুরগুলোও সামান্য একটু দূরে চলে গেলো। তাপর আবার দুই কদম এগুলো। প্রচণ্ড ভয়ের মধ্যেও সে এভাবে এক পা দু পা করে এগুতে থাকলো। প্রায় দুই ঘন্টা হাঁটার পর কুকুরগুলো একটা দুইটা করে চলে যেতে থাকলো। কারণ এতক্ষণে কুকুরগুলোর নিজস্ব এরিয়া থেকে সে অনেকটা দূরে সরে আসতে সক্ষম হয়েছে। সে নিজেকে মুক্ত দেখে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করল। এতক্ষণে তার মায়ের কথা মনে পড়ল এবং মনটা ভীষণ খারপ হয়ে গেলো। হঠাৎ দু চোঁখ বেয়ে দর দর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তারপর বুকে সাহস সঞ্চয় করে আবারও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন