রবিবার, ২৪ মার্চ, ২০২৪

বাড়ি নির্মাণে আমরা যে ভুলগুলো করিঃ একটি আদর্শ বাড়ির বৈশিষ্ট্য


বাড়ি নির্মাণে কমন ভুলঃ

যেই বাড়িটি আপনি পুরো জীবন অতিবাহিত করার জন্য নির্মাণ করবেন, তা হোক যেনতেন একটা বাড়ি এটা কি কখনো চাইবেন? না, বরং আপনি চাইবেন তা হোক সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ, নির্ঝঞ্চাট, সুন্দর ও আকর্ষণীয়। তাই নয় কি? কিন্তু আমরা বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রায় অধিকাংশ মানুষই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি, যার কারণে আমাদেরকে কষ্ট ভোগ করতে হয় প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

স্থান নির্বাচন: আপনার হাতে যদি পর্যাপ্ত টাকা থাকে আর যদি বলা হয় আপনার বাড়িটি কোথায় হওয়া চাই? তখন আপনি চোখ বুজে বলে দেবেন- আমার বাড়িটি হতে হবে একদম রাস্তার সাথেই।কিন্তু আপনি চিন্তা করে দেখেন না যে, রাস্তা ঘেষা বাড়ি হলে আপনার আসলেই সুবিধা হবে নাকি বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হবে। হ্যা, আপনার বাড়িটি একদম রাস্তার পাশে হলে আপনাকে নানাবিধ সমস্যায় পড়তে হবে এবং এটা হতে পারে আপনার সিদ্ধান্তের মধ্যে সবচেয়ে বড় একটি ভুল সিদ্ধান্ত। রাস্তার সাথে লাগোয় বাড়ি হলে আপনি যে সকল সমস্যার সম্মুখিন হতে পারেন-

১. শব্দ দূষণ: রাস্তার সাথে বাড়ি হলে আপনার জন্য শব্দ দূষণের সাগরে ডুবে থাকা অবধারিত।রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়া প্রতিটি গাড়িই আপনার বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়াবে।তাছাড়া মিছিল, মাইকিং ইত্যাদির শব্দ পাওয়ার অগ্রাধিকার লাভ করবেন, যদি হয় রাস্তার পাশেই আপনার সখের বাড়িটি।

২. বায়ু দূষণ: গাড়ি চলাচলের সময়- ধুলো-বালি উড়বেই। এটাকে কোনভাবেই ঠেকাতে পারবেন না। আর এতে করে আপনার বাড়ি ও বাসার কাপড়-চোপড় খুব তাড়াতাড়ি ময়লা হয়ে যাবে। তাছাড়া বাড়িতে অতিরিক্ত ময়লার আনাগোনা থাকার করণে এবং গাড়ি চলাচলের দরুণ পরিবেশ সর্বদা বেশি উত্তপ্ত হওয়ার কারণে এখানে গাছপালাও ভালভাবে বেড়ে উঠবে না, হলেও তা ময়লায় ছেয়ে থাকবে। আর গাছপালা না থাকাও পরিবেশ উত্তপ্ত থাকার প্রধান একটি কারণ। 

৩. রাজনৈতিক প্রভাব: রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আপনার সখের বাড়িটি ভাঙচুর হতে পারে যদি তা হয় রাস্তার সাথেই। তাছাড়া আপনাকে অযথা বিভিন্ন দুর্ঘটনার স্বাক্ষী হওয়া লাগতে পারে। যেমন- চুরি, ডাকাতি, খুন, রোড এক্সিডেন্ট ইত্যাদি।

৪. শিশুদের জন্য কারাগার: আপনার বাড়িটি যদি হয় রাস্তার সাথেই, তবে তা হয়ে উঠবে শিশুদের জন্য অঘোষিত কারাগার।শিশুদেরকে আপনি বাইরে বের হতে দেবেন না। কারণ, আপনি চাইবেন না তারা গাড়ি এক্সিডেন্টের সম্মুখীন হোক।ফলে তারা খেলাধুলা ও দৌড় ঝাপ করার বয়সে হয়ে যাবে একেবারে বন্দি। এতেকরে তাদের বেড়ে ওঠা ও সৃজনশীল মানসিকতা তৈরিতে হবে বাধাপ্রাপ্ত।

৫. চুর-ডাকাতের ভয়ঃ ঘর-বাড়ি রাস্তার সাথে থাকলে চুরি-ডাকাতি বেশি হওয়ার প্রবণতা থাকে। কারণ, মাল নিয়ে রাস্তায় নামতে পারলেই তাদের ঠেকানোর আর উপায় থাকেনা, দ্রুত প্রস্থান করে চুখের 

৬. পর্দার বেঘাতঃ যারা পর্দা রক্ষা করে চলতে চান তাদের জন্যও সমস্যা হয়ে দাড়ায়। রাস্তা ঘেষা বাড়ি থাকলে চলতে ফিরতে আচমকা অজানা-অচেনা মানুষের সামনে পড়তে হতে পারে যে কোন সময়। 

কোথায় হবে স্বপ্নের বাড়ি: উপরের বিষয়গুলো জানার পর আপনার একটি প্রশ্ন অবশ্যই আসবে। তা হলো- তাহলে কোথায় বাড়িটি নির্মাণ করা উচিত? রাস্তা থেকে বহুদূরে? না, রাস্তা থেকে বহু দূরেও নয় আবার রাস্তার একেবারে সাথেও নয়। আপনার বাড়িটি মূল রাস্তা থেকে বেশি ভিতরে হলেও বহুবিধ সমস্যায় পড়বেন। যেমন- বিপদ মুহূর্তে তাড়াতাড়ি প্রস্থানে সমস্যা হবে, অসুস্থ রোগীকে তড়িৎ গতিতে আনা-নেওয়াতে বিঘ্ন হবে, আরও আরও অজানা সমস্যার সম্মুখিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আপনি রাস্তার পাশের বাড়ি হতে দুই/তিনটি বাসার পরের স্থানটি নির্বাচন করতে পরেন। একটু চিন্তা করে দেখুন, যদি একটু ভিতরে হয় তবে উপরের সবগুলো সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন। পাশাপাশি আপনার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বাড়ি এবং তার আশপাশে বের হতে পারবে। যেহেতু তারা ছোট তাই তাদের পক্ষে দুই তিন বাড়ি ডিঙ্গিয়ে রাস্তায় এসে এক্সিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আর যখন আরও একটু বড় হয়ে রাস্তায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে, ততদিনে নিজেরাই বিপদ থেকে মুক্ত থাকার জ্ঞানে উপনীত হযে যবে। আবার যাতায়াতের সুবিধাও পাবেন পুরোপুরি।সেই সাথে ধুলো-বালি মুক্ত, ভয়-সংকামুক্ত, গাছা-পালা বেড়ে উঠার পরিবেশ পেয়ে যাচ্ছেন নিশ্চিতভাবে।

একটু ভিতরে হলে আরও একটা বড় যে সুবিধা পাবেন তা হলো- স্থানটিও তুলনামূক কম দামে পাচ্ছেন। কমন ভুলের কারণে যেহেতু রাস্তার সাথেই সবাই নিজের বাড়িটি করতে চায় আর না জেনে বেশি টাকায় অতিরিক্ত ঝামেলা বহন করে থাকে, তাই সুবিধার জায়গাগুলো যে একটু কম দামেই পেয়ে যাবেন, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

বাড়ির গাছপালার বিন্যাস: আপনি যদি যেনতেনভাবে গাছগুলো যেখানে সেখানে লাগান, একটু মাথা না খাটান, তবে তা হয়ে উঠতে পারে আপনার জন্য বিপদের কারণ। তাই কী ধরনের গাছ বাড়ির কোন দিকে লাগাবেন তা চিন্তা করেই লাগাতে হবে।আপনি যদি বড় যাতের গাছগুলো বাড়ির পশ্চিম পার্শ্বে লাগান তবে ঝড়ের সময় গাছগুলো ভেঙে আপনার দালানে/ টিনের ঘরের উপর এসে পড়বে।অথবা তার ফলগুলো প্রচন্ড বেগে এসে টিনে বা জানালায় আঘাত করে ভয়াবহতাকে কয়েকগুণে বাড়িয়ে তুলবে।কারণ, ঝড়ো হাওয়া এবং তুফান সর্বদা পশ্চিম দিক থেকেই প্রবাহিত হয়।এই একটি উদাহরণের মাধ্যমেই আপনার বুঝার কথা- গাছপালা লাগানোর সময়ও ভবিষ্যৎ সময়ের চিন্তা করার গুরুত্ব আছে। তাহলে চলুন জেনে নিই কী ধরনের গাছ কোন পাশে লাগানো উচিত:-

গাছগুলো হোক পরিকল্পিত : আপনার মাথায় এটা অবশ্যই রাখতে হবে যে, মৃদুমন্দ ও আরামদায়ক ঠান্ডা বাতাস সর্বদা পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়।তাই আম, জাম, কাঠাল, নাড়িকেল ইত্যাদি বড় জাতের গাছগুলো বাড়ির পূর্ব পার্শ্বে হলে বেশ কিছু সুবিধা পাবেন। যেমন- ঝড়-বৃষ্টিতে কোন গাছ ভেঙ্গে পড়লে তা যেমন বাড়িতে এসে পড়বে না, তেমনি বাড়ি ভেঙ্গে গেলে বা বড় কিছু উড়ে গেলে তা বড় গাছগুলোতে এসে আটকে যাবে। এতেকরে সেগুলো দূরে হারিয়ে যাবার সম্ভাবনাও কমে যাবে।আবার পূর্বদিকে গাছগুলো থাকার ফলে গরমের দিনে যেমন তার ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে শান্তি পাবেন, তেমনি গাছ থাকার দরুণ প্রবাহিত ঠান্ডা বাতাস ঘরে বসেও উপভোগ করতে পারবেন ।মূলত গাছপালাহীন স্থানে বাতাস তেমন উনুভূত হয় না।ছোট জাতের গাছপালা বাড়ির পশ্চিম দিকে রাখাই ভাল।এতেকরে এগুলো ঝড়ের সময় বিপদের কারণ হতে পারবে না।

পরিবেশ ও স্বাস্থ্য রক্ষায় গাছপালা: গাছপালা মানুষ ও প্রকৃতির সেরা বন্ধু। মানুষ এবং সকল প্রাণীর বেঁচে থাকার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান অক্সিজেন এই গাছের মাধ্যমেই পেয়ে থাকি।আমাদের খাবার এবং প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র এই গাছ থেকেই আমরা পেয়ে থাকি। আবার আমরা অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসক যে পথ্য দেন তা-ও এই গাছ থেকেই তারা প্রস্তুত করেন।কিছু কিছু গাছ বাড়ির আঙিনা বা আশপাশে থাকলে রোগ-বালাই বাড়িতে সহজে হানা দিতে পারে না। যেমন- নীম গাছ, তুলসি গাছ, অর্জুন গাছ ইত্যাদি।রোগ বালাই প্রতিরোধে আরও অনেক ঔষধি গাছ আছে, এখানে আপনাকে শুধু স্মরণ করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলো। জ্হানীদের জন্য ইশারাই যথষ্ট।

বন্ধু বেশে শত্রু: মনে রাখবেন, সকল মানুষ যেমন আপনার বন্ধু নয়, কেউ কেউ শত্রুও হয়। তেমনি সকল গাছও মানুষ এবং পরিবেশের বন্ধু নয়, বরং কিছু কিছু গাছ মানুষ ও প্রকৃতির শত্রুর ভূমিকা পালন করে থাকে। ইউকিলিপ্টাস গাছের কথাই ধরুন- এই গাছ তো অক্সিজেন দেয়ই না, বরং তা মানুষ এবং চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় অক্সিজেন গ্রহণ করে থাকে। আবার তার পাতার বিষক্রিয়ায় মাটির ঊর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়।আবার বাহারি পাতা, যা মানুষ সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্য বাড়িতে চাষ করে থাকে। এগুলোর পাতা খুবই বিষাক্ত, যা শিশুরা ভুল করে খেলে মৃত্যু অনিবার্য্য।তাই আপনার জানা উচিত কোন গাছ আপনার বন্ধু আর কোনটি ক্ষতিকর।

দরজা-জানালার অবস্থান: শীতের সকালের আরামদায়ক কাঁচা রোদ এবং গরম দিনে মন জুড়ানো ঠান্ডা ও শীতল বাতাস জানালা দিয়ে উপভোগ করতে চাইলে আপনার জানালাটি রাখতে হবে পূর্ব পার্শ্বে। দরজা বা জানালা যদি ভুল করে পশ্চিম দিকে রাখেন তবে ঝড়ের দিনে দরজা-জানালার ফাঁক ফোকর দিয়ে পানি এসে ঘরে প্রবেশ করবেই, কোনভাবেই তা আটকিয়ে রাখতে পারবেন না। দরজাটি উত্তরমূখী হলে মোটামুটি সবচেয়ে নিরাপদ বলা যায়। তবে তা পূর্ব দিকে হলেও মন্দ নয়।কিন্তু এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে যে, গরম দিনে দরজা দিয়ে বাতস উপভোগ করা গেলেও মৃদু ঝড়ো বৃষ্টি পূর্ব দিক থেকেও মাঝে মাঝে প্রবাহিত হয়।

লেখাটি কেমন লেগেছে তা কমেন্টে জানাতে ভূলবেন না।আপনাদের সাড়া পেলে আরও কিছু নতুন বিষয় নিয়ে হাজির হবো।আজ এখানেই শেষ করলাম।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন