ভূমিকাঃ গল্প-সাহিত্যে এবং কবিতা-উপন্যাসে পানিকে যতটা গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করা হয়েছে সেই বিচারে মাটি যেন একেবারেই অবমূল্যায়িত রয়ে গেছে। অথচ একজন তৃষ্ণার্ত পথিক পানি খোঁজার জন্য যখন হাটে তখন তার পায়ের নিচের অবলম্বনটুকু হয় এই মাটি। শুধু তাই নয়, যখন সে গাছের ছায়ায় বা ঘরের বিছানায় সুখের ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে তখনও তাকে পরম মমতায় আগলে রাখে মাটি। পৃথিবী এবং মানুষের প্রায় সকল ঘটনার নিরব স্বাক্ষী এই মাটি।পৃথিবীর প্রায় সকল দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য বস্তুর একমাত্র আশ্রয়স্থল হল মাটি। এমনকি আমরা যে পানিকে গল্প-গান ও কবিতায় বিশেষ মর্যাদার সাথে উল্লেখ করে থাকি, সেই পানিকে বুকে ধারণ করে রাখে এই মাটি। সেই দৃষ্টিতে বিচার করলে দেখা যাবে আমরা মাটিকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছি।তবে, গল্প-সাহিত্যে মাটিকে মূল্যায়ন করা হোক আর নাই হোক বাস্তবতা হলো- মানুষের জন্য মাটি এক অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। মাটি ছাড়া কোন কিছু কল্পনা করাই মুশকিল। তাই এখানে বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের জীবনে মাটির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কিছু বাস্তবধর্মী কথামালা উল্লেখ করা হলো-
গাছপালা ও ফসল উৎপাদনে মাটির প্রয়োজনীয়তাঃ
আমরা যা খেয়ে জীবন ধারণ করে থাকি তার সবকিছুই নির্ভর করে এই মাটির উপর। গাছপালা ও ফসলের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন মাটি, তারপর অন্যকিছু। এমন কি আমরা যে সকল প্রাণীর মাংস খাই তারাও লতাপাতা এবং যেসকল খাবার খেয়ে দেহ বৃদ্ধি করে থাকে তা উৎপাদিত হয় মাটিতেই। গাছ-পালা কিংবা যে কোন প্রাণীর জন্য পানি প্রয়োজন বটে, কিন্তু মাটি হল অত্যাবশ্যকীয়। মাটি ছাড়া শুধুমাত্র পানির উপর প্রয়োজনীয় গাছপালা এবং ফসল উৎপাদন চিন্তা করা যায় না। আপনার কাছে পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা ও স্বর্ণমুদ্রা থাকলেও যদি খাবার না থাকে তবে সেগুলোর কোনই মূল্য নেই। কিন্তু যদি আপনার কাছে যথেষ্ট খাবার থাকে এবং হাতে কোন টাকা-পয়সা বা স্বর্ণমুদ্রা না থাকে তবে কোন সমস্যাই হবে না। আর খাবার উৎপাদনের জন্য চাই মাটি। তাই বলা যায় পৃথিবীতে সবচাইতে মূল্যবান বস্তু হলো মাটি।
আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় মাটির প্রয়োজনীয়তাঃ
আমাদের স্বাস্থের জন্য মাটি এক অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। আপনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দোহাই দিয়ে মাটির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তাই সুস্থ দেহ-মনের জন্য মাঝে মাঝে খালি পায়ে মাটিতে হাটাহাটি করতে হবে। মাটির বাঁধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকা আমাদের জন্য অসম্ভব।
হাজারও গুপ্তধনের সিন্ধুকঃ
আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় মাটি হলো হাজারও গুপ্তধনের সিন্ধুক। কারণ এই মাটির মধ্যেই রয়েছে অমূল্য সব ধনভান্ডার। স্বর্ণের খনি, হিরার খনি, তেল, গ্যাস কয়লার খনি আরও যে কতশত প্রয়োজনীয় এবং মূল্যবান উপাদান রয়েছে তার কোন হিসাব নেই।
মাটির আসবাবপত্রের উপকারিতাঃ
মানুষের ব্যবহৃত আসবাবপত্রের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ হলো মাটির আসবাবপত্র। সীসার পাতিলে রান্নার সময় সীসা উত্তপ্ত হয়ে তার বিষাক্ত পদার্থ খাবারে মিশে গিয়ে শরীরে বিভন্ন রোগের সৃষ্টি করে। প্লাস্টিকের জগ, মগ ও বোতলে জলযুক্ত খাবার যেমন- তরকারি, দুধ, পানি ইত্যাদি দীর্ঘক্ষন রেখে দিলে বা উত্তপ্ত অবস্থায় রাখলে তা থেকেও বিষাক্ত প্লাস্টিকের উপাদান মিশে গিয়ে শরীরে বিভিন্ন মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে থাকে। কিন্তু মাটির পাত্র সম্পূর্ণ নিরাপদ। উল্টোদিকে মাটির এমন গুণ রয়েছে যে, মাটি সব ধরনের বিষক্রিয়া নিষ্কৃয় করতে সক্ষম। তাছাড়া মাটি বহু রোগের জীবাণুও ধ্বংস করে থাকে।
মাটির ঘর যেকারণে সবচেয়ে আরামদায়কঃ
মাটি হলো তাপ কুপরিবাহী। অর্থাৎ মাটির মধ্য দিয়ে সহজে তাপ পরিবাহিত হতে পারে না। আর একারণেই গরমকালে যখন সূর্যের উত্তাপে চারদিক প্রচন্ড উত্তপ্ত থাকে তখন মাটির ঘরের ভিতরটা থাকে অধিকতর ঠান্ডা। আবার শীতকালে মাটির ঘরের ভিতরটা থাকে তুলনামূলক গরম।কারণ, গরমকালে সূর্যের উত্তাপের ফলে ক্রমান্বয়ে যে দেয়ালের ভেতরের দিক উত্তপ্ত হয়েছিল তা বাহিরের ঠান্ডার কারণে দ্রুত ঠান্ডাও হতে পারে না।
পরিবেশ দূষণকারী বস্তুকে মাটিতে পরিণত করতে পারে মাটি:
মাটির এক অকল্পনীয় গুণ হলো, পরিবেশ দূষণকারী প্রায় সকল বস্তুকেই সে মাটিতে পরিণত করতে পারে। মাটি যদি এই গুণের অধিকারী না হতো তবে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা আমাদের জন্য অসম্ভব হযে দাড়াতো। চিন্তা করে দেখুন, পৃথিবীর শুরু থেকে প্রতিনিয়ত কত রকমের আবর্জনা আমরা তৈরি করছি।আমরা কত রকমের খাবার নষ্ট করে ছুড়ে দিচ্ছি এই মাটির উপর, মানুষ এবং জানা অজানা লক্ষ কোটি প্রাণী প্রতিদিন এই মাটির উপর মল ত্যাগ করছে, প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ প্রাণী মরছে। এভাবে আমরা পরিবেশকে সর্বদা নষ্ট করার কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু মাটি একটি নির্দিষ্ট সময় পর সবকিছুকে মাটিতে পরিণত করে ফেলছে। যদি মাটির এই অসাধারণ গুণটি না থাকতো তবে আজ আমাদের পক্ষে এই মাটির উপর বসবাস করা ও টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতো।
বিষক্রিয়া ধ্বংস করতে পারে মাটি:
আমরা মানুষেরা প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে কত রকমের বিষ উৎপাদন করছি প্রতিনিয়ত। তার কোনটা প্রয়োগ করছি ফসলের উপর, আবার কোনটা প্রয়োগ করছি ক্ষতিকারণ প্রাণী মারার কাজে। যেভাবেই ব্যবহার করিনা কেন সবকিছুই একসময় তা এই মাটির উপরেই পতিত হচ্ছে। এভাবে আমরা শত শত বছর ধরে মাটিতে প্রতিনিয়ত বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছি। কিন্তু মাটি আজও ফল-ফসল দিচ্ছে। যদি মাটি এই বিষকে নিঃশেষ করতে না পারতো তবে আমরা এই মাটির উপর কোন ফসল উৎপাদন করতে পারতাম না এবং এই মাটির উপর বসবাস করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না।
মৃত্যুর পর মাটিই হবে শেষ ঠিকানাঃ
মানুষ বা যেকোন প্রাণী মৃত্যুর পর মাটিই একমাত্র স্থান যেখানে সবার শেষ গন্তব্য। আর মাটি এমন গুণসম্পন্ন বস্তু যে, সে সবকিছুকে শেষ পর্যন্ত মাটিতে পরিণত করতে পারে। তাই আমরা সর্বদা পৃথিবীকে বাসের অনুপযোগী করার কাজে লিপ্ত থাকলেও যুগ যুগ ধরে এই মাটি পৃথিবীকে বাসের যোগ্য করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
শেষকথাঃ
আর্টিকেলটি কেমন লেগেছে তা কমেন্ট করে যানাতে ভুলবেন না। লেখাটি ভাল লাগলে সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করে অন্যকেও জানার সুযোগ করে দিন। লেখাগুলো প্রকাশ হবার সাথে সাথে পেতে চাইলে এই সাইটে আমাকে ফলো করে রাখতে পারেন।লেখাটি শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন