অভিযোগ-১: সালাতকে বিকৃত করেছে: খেয়াল করলে দেখবেন যে, সালাতের বিষয়ে প্রত্যেক ইমামের রায়েই বৈপরিত্য আছে। যেমন- হানাফিরা নাভির উপর বা নিচে হাত বাধে আবার শাফেয়ী ও সালাফিরা বাঁধে বুকের উপর। আবার হাম্বলী মাযহাবের অনুসারীগণ হাত বাঁধে বুক ও পেটের মাঝামাঝি। আবার ইমাম মালেকের অনুসারীরা সালাতে হাত বাঁধেই না। তারা হাত ছেড়ে দিয়েই সালাত আদায় করে। এটা শুধুমাত্র হাত বাঁধা নিয়ে। তারপর ইমামের পিছনে মুসল্লিরা সূরা ফাতিহা পড়বে কি পড়বে না, দোয়াল্লিন নাকি জোয়াল্লিন, আমিন জোরে পড়বে নাকি আস্তে পড়বে ইত্যাদি হাজারো মাসয়ালাগত পার্থক্য। এখন প্রশ্ন হলো- মাজহাবী আলেমদের এতগুলো বৈপরিত্ব থাকা সত্বেও কেউ তাদেরকে সালাতে বিকৃতিকারী বলছেন না তবে শুধুমাত্র আমাদের বেলায় কেন এই অভিযোগ? আমরা তো চার রাকাতের সালাতে দুই রাকাত বা তিন রাকাত পড়ছি না! তাহলে সালাতের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আমাদের ইমামের রায়কে সালাতে বিকৃতি বলে মনে করছেন? প্রত্যেক ইমামের মতো তিনিও যেভাবে সঠিক মনে করেছেন সেভাবেই রায় দিয়েছন! এক্ষেত্রে শুধুমাত্র আমাদের বেলায় সালাত বিকৃতিকারী বলাটা কি ন্যায়সংগত হলো? বড়াবাড়ি হয়ে গেলো না?
অভিযোগ-২: মহিলারা পর্দা করে না: আমাদেরকে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে
যে, ইসলামের যে কোন বিধান সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি বুঝেছেন বিশ্বনবী (সাঃ)। কেননা স্বয়ং
তার উপরই এই বিধান নাজিল হয়েছে, এই বিধান প্রতিষ্ঠার গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং তিনিই
মুসলিমদের মধ্যে চেয়ে বেশি তাক্বওয়াবান ছিলেন। তাই তার চেয়ে বেশি তাক্বওয়া প্রদর্শন
ইসলামে বাড়াবাড়ি বা ইসলামের বিকৃতি হিসেবে গণ্য হবে। এ বিষয়ে একটি হাদিস লক্ষ্য করুন-
আনাস (রাঃ) বলেন,
তিন ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রীদের বাসায় এলেন। তাঁরা
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। অতঃপর যখন
তাঁদেরকে এর সংবাদ দেওয়া হল তখন তাঁরা যেন তা অল্প মনে করলেন এবং বললেন, ’আমাদের
সঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তুলনা কোথায়? তাঁর তো আগের ও পরের
সমস্ত গোনাহ মোচন ক’রে দেওয়া হয়েছে। (সেহেতু আমাদের তাঁর চেয়ে বেশী ইবাদত করা
প্রয়োজন)।’ সুতরাং তাঁদের মধ্যে একজন বললেন, ’আমি সারা জীবন রাতভর নামায পড়ব।’
দ্বিতীয়জন বললেন,
’আমি সারা জীবন সিয়াম রাখব, কখনো সিয়াম ছাড়ব না।’ তৃতীয়জন বললেন, ’আমি নারী থেকে
দূরে থাকব, জীবনভর বিয়েই করব না।’ অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম তাঁদের নিকট এলেন এবং বললেন, ’’তোমরা এই এই কথা বলেছ? শোনো! আল্লাহর
কসম! আমি তোমাদের চেয়ে বেশী আল্লাহকে ভয় করি, তার ভয় অন্তরে তোমাদের চেয়ে বেশী
রাখি। কিন্তু আমি (নফল) সিয়াম রাখি এবং সিয়াম ছেড়েও দিই, নামায পড়ি এবং নিদ্রাও
যাই। আর নারীদের বিয়েও করি। সুতরাং যে আমার সুন্নাত হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে আমার
দলভুক্ত নয়। (বুখারী
৫০৬৩, মুসলিম ৩৪৬৯)
চলুন এখন দেখা যাক রাসূল
(সাঃ) এর যামানায় মহিলাদের পর্দা কেমন ছিল-
রাসূলের (সাঃ) যামানায় মহিলাদের পর্দার স্বরূপ: রাসূলের যামানায় সকল মুসলিম কি বোরখা
পরিধান করতো? কিংবা অন্ততপক্ষে সকল মুসলিম মহিলা কি হাত-মুখসহ সমস্ত দেহ ঢেকে রাখতো?
চলুন কয়েকটি হাদিসের মাধ্যমে তা বুঝার চেষ্টা করি-
১। “আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত।
তিনি বলেন, একবার কুরবানীর দিনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাযল ইবনু
’আব্বাস (রাঃ)-কে আপন সওয়ারীর পিঠে নিজের পেছনে বসালেন। ফাযল একজন সুপুরুষ ছিলেন। নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকেদের মাসআলা মাসায়িল বলে দেয়ার জন্য আসলেন। এ সময়
খাশ’আম গোত্রের এক সুন্দরী নারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট
একটা মাসআলা জিজ্ঞেস করার জন্য আসল। তখন ফাযল তার দিকে তাকাতে লাগলেন। মহিলাটির সৌন্দর্য
তাঁকে আকৃষ্ট করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাযল এর দিকে ফিরে দেখলেন যে,
ফাযল তার দিকে তাকাচ্ছেন। তিনি নিজের হাত পেছনের দিকে নিয়ে ফাযল এর চিবুক ধরে ঐ নারীর
দিকে না তাকানোর জন্য তার মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন।” সহীহ বুখারী (তাওহীদ
পাবলিকেশন) [হাদিস: ৬২২৮]
লক্ষ করুন, রাসূল (সাঃ)
পুরুষের মুখ বার বার ঘুরিয়ে দিলেন। মহিলাকে পর্দার উপদেশ দিলেন না। কিন্তু আজকের মোল্লারা
কি করতো? প্রথমেই মহিলাকে ধমক দিয়ে তাকে পর্দা করার উপদেশ দিতো।
২।জাবের ইবন আব্দুল্লাহ
রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামের সাথে ঈদের দিন সালাতে উপস্থিত হলাম। তিনি আযান ও ইকামত ছাড়া খুতবার আগে
সালাত আরম্ভ করলেন। তারপর বিলালের ওপর হেলান দিয়ে দাড়ালেন এবং তাকওয়া অবলম্বন করার
নির্দেশ দিলেন এবং তার অনুকরণ করার ওপর উৎসাহ দিলেন। তিনি মানুষকে নসিহত করলেন এবং
স্মরণ করিয়ে দিলেন। তারপর তিনি মহিলাদের নিকট আসলেন তাদেরকেও ওয়াজ ও নসিহত করলেন এবং
বললেন, তোমরা সাদাকাহ কর, কারণ, তোমাদের অধিকাংশই জাহান্নামের খড়ি। মহিলাদের মাঝখানে
বসা রঙ্গীন চেহারা বিশিষ্ট এক নারী দাড়ালো এবং বলল, কেন? হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন,
কারণ, তোমরা অভিযোগ বেশি কর এবং স্বামীর নাফরমানি করো। তিনি বলেন: তারপর তারা তাদের
স্বর্ণ—অলংকার থেকে দান করা আরম্ভ করে। তারা বিলালের কাপড়ে তাদের কানের দুল এবং আংটি
ডেলে দিলেন।[সহীহ] - [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও
মুসলিম)।]
হাদিসটিতে মহিলার মুখের
বর্ণনা এসেছে। যদি মহিলার মুখ খোলা না থাকতো তাহলে তার মুখের বর্ণনা করা সম্ভব হতো
কি?
এখন এদেশের কথিত আলেমদের
প্রতি প্রশ্ন হলো- বর্ণিত এই হাদিসগুলোকে কি মিথ্যা প্রমাণ করতে পারবেন? যদি না পারেন
তাহলে অন্তত এটুকু বুঝতে পারছেন কি যে, পর্দা নিয়ে আপনাদের অবস্থান বাড়াবাড়ি?
এখন যদি ধরেও নেওয়া
হয় যে, আমাদের সংগঠনের মহিলাদের পর্দা সঠিক হচ্ছে না। তাহলে এদেশের বাকি সাধারণ মুসলিম
মহিলাদের পর্দা আপনারা ফতোয়া দিয়ে ঠিক করছেন না কেন?
আবার সাধারণ মুসলমানসহ
সকলকে একসাথে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাড় না করিয়ে শুধুমাত্র বেছে বেছে এই সংগঠনকে কাঠগড়ায়
দাঁড় করানো কি ইনসাফের খেলাফ নয়?
আজকের কথিত আলেমদের কাছে আরও কিছু প্রশ্ন: রাসূল (সাঃ) এর কোন ফরজ সালাত কি
মহিলা মুসল্লি ছাড়া হতো? রাসূলের যুগে যানাজা ও ঈদের সালাতে মহিলারা শামিল হতো। আজকে
সেই ইবাদগুলোতে শামিল করা হচ্ছে না কিন্তু স্কুলে পড়ানো, মার্কেটে ঘুরতে দেওয়া, এবং
ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হওয়া থেকে ঠেকাতে পারছেন কি? একদিকে রাসূল (সাঃ) এর চেয়েও বেশি
তাকওয়া দেখাতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। আরেক দিকে তাদের হাতে ইসলামের আইন বাস্তবায়নের ক্ষমতা
না থাকায় কেউ তাদের ফতোয়াকে পাত্তাই দিচ্ছে না।
অভিযোগ-৩: গান-বাজনাকে হালাল করে নিয়েছে: এখানেও প্রথমেই স্বরণ করিয়ে দিতে
চাই যে, রাসুল (সাঃ) এর চেয়ে বেশি পরহেজগারী দেখানো শুধু অনুচিতই নয় বরং তা ইসলামে
বাড়াবাড়ি ও নিজেকে ধ্বংস করার শামিল। যা উপরের হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণ করে এসেছি। এখন
চলুন হাদিস থেকে বুঝার চেষ্টা করি রাসূল (সাঃ) এর যামানায় গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার
মুসলিম সমাজে প্রচলিত ছিল কি-না:-
১। আল্লাহর রসুল বলেছেন,
‘তোমরা এই বিবাহের ঘোষণা দাও। এটা মসজিদে সম্পন্ন করো এবং বিবাহ উপলক্ষে দফ বাজাও।’ (তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ।)
২। রসুলাল্লাহর নারী
সাহাবি রুবাই বিনতে মুআব্বিয ইবনু আফরা (রা.) বলেন,‘আমার বাসর রাতের পরের দিন নবী (সা.) এলেন এবং আমার বিছানার
ওপর বসলেন, যেমন বর্তমানে তুমি আমার কাছে বসে আছ। সে সময়ে মেয়েরা দফ বাজাচ্ছিল এবং
বদর যুদ্ধে শাহাদাত প্রাপ্ত আমার বাপ-চাচাদের শোকগাঁথা গাচ্ছিল। তাদের একজন গাইছিল-
আমাদের মধ্যে এক নবী আছেন, যিনি ভবিষ্যৎ জানেন। তখন রসুলাল্লাহ বললেন, এ কথাটি বাদ
দাও, আগে যা গাইছিলে তাই গাও (সহিহ বোখারী, হাদিস নং ৫১৪৭)।‘
লক্ষ্য করুন, এখানে
রসুলাল্লাহ (সা.) মেয়েদেরকে গান গাইতে বারণ করলেন না, কিন্তু তাঁর ব্যাপারে একটি মিথ্যা
ধারণা তিনি সংশোধন করে দিলেন। কেউ কেউ বলে থাকেন, এসব হাদিস থেকে বোঝা যায় কেবল দফ
বাজানো জায়েজ, বাকি সব বাদ্যযন্ত্র হারাম। বস্তুত সে যুগে আজকের মতো এত সব বাদ্যযন্ত্রই
ছিল না, ছিল কেবল দফ, তাম্বুরা ইত্যাদি। সেগুলোই তারা বাজাতেন।
জাহেলিয়াতের যুগে আরবে
গান আর অশ্লীলতা ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই অনেক সাহাবি গানকেই ফাহেশা কাজ বা মন্দ
কাজ বলে ভাবতে লাগলেন। কিন্তু রসুলাল্লাহ (সা.) তাঁদের এই ভুল ধারণা ভাঙিয়ে দিলেন।
আম্মা আয়েশা (রা.) গান পছন্দ করতেন। তাঁর গৃহে রসুলাল্লাহর (সা.) উপস্থিতিতেই গান গাওয়ার
দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
(ক) একদিন দুটো মেয়ে
রসুলাল্লাহর ঘরে দফ ও তাম্বুরা বাজিয়ে গান গাইছিল। রসুলাল্লাহ শুয়ে ছিলেন। আম্মা আয়েশাও
(রা.) গান শুনছিলেন। এমন সময় তাঁর পিতা আবু বকর (রা.) আসেন এবং আম্মা আয়েশাকে (রা.)
তিরস্কার করেন। তখন আল্লাহর নবী আবু বকরের (রা.) দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আবু বকর! তাদেরকে
তাদের কাজ করতে দাও। আজ তাদের ঈদের দিন।’ (সহিহ বোখারী,
হাদিস নং ৯৮৭)।
(খ) আয়েশা (রা.) একটি
মেয়েকে লালন পালন করতেন। অতঃপর তাকে এক আনসারের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানস্থল থেকে
আয়েশা (রা.) এর প্রত্যাবর্তনের পর রসুলাল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি গীত গাইতে
পারে এমন কাউকে সেখানে পাঠিয়েছ?’ আয়েশা (রা.) বললেন, ‘না’। রসুলাল্লাহ বললেন, ‘তুমি তো জান আনসাররা অত্যন্ত সংগীতপ্রিয়’ (মিশকাতুল মাসহাবি)।
(গ) আবু বোরায়দা (রা.)
বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (স.) কোনো একটি যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সময় একজন কৃষ্ণাঙ্গ
নারী সাহাবী মহানবী (স.) এর সামনে এসে বললেন যে- ‘ইয়া রসুলাল্লাহ, আমি মানত করেছিলাম
যে, আপনাকে নিরাপদে আল্লাহ ফিরিয়ে আনলে আমি আপনার সামনে দফ বাজিয়ে গান গাইব।’মহানবী (স.) বললেন, ‘যদি তুমি মানত করে থাক তাহলে বাজাও। মানত
পূর্ণ কর। তারপর মেয়েটি দফ বাজিয়ে গান গাইতে লাগল।’ [তিরমিজি ২য় খণ্ডের ২০৯-২১০ পৃষ্ঠা, মেশকাত শরিফের ৫৫৫ পৃষ্ঠা
ও আবু দাউদ শরিফ]।
x



